যুগ্ম সচিবের জন্য ফেরি অপেক্ষায় রাখার পর অ্যাম্বুলেন্সে থাকা স্কুলছাত্রের মৃত্যু নিয়ে তুমুল আলোচনার দুই বছরের মাথায় একই রকম একটি ঘটনা ঘটল পটুয়াখালীতে।
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার নদী পার হবেন বলে ফেরিতে উঠতে দেয়া হয়নি শ্বাসকষ্টের রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে।
ঈদের দিন শুক্রবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটে লেবুখালী ফেরিঘাটে।
জাতীয় পার্টির নেতা ও তার সঙ্গে থাকা তিনটি পাজেরো তোলার পর আর কোনো গাড়িকে তুলতে দেয়া হয়নি।
এই ফেরিতে নয় থেকে ১২টা গাড়ি উঠাতে পারে। কিন্তু হাওলাদার ও তার সঙ্গীদের তিনটি গাড়ির বাইরে কেবল ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি গাড়ি ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এই ঘটনায় হাওলাদারের কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফেরির চালক ও লস্কর। স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও বিষয়টি শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।
পেছন থেকে এসে হাওলাদার যখন ফেরিতে উঠেন, তখন সাইরেন বাজিয়ে সেখানে উঠার চেষ্টা করে অ্যাম্বুলেন্সটি
স্থানীয়রা জানান, ফেরি আসবে বলে অ্যাম্বুলেন্সসহ গাড়িগুলো দাঁড়িয়েছিল। রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার সঙ্গীদের দুটি গাড়ি ছিল পেছনে। এর মধ্যে ফেরি আসার পর সামনের গাড়ি রেখে পেছনের গাড়িগুলো তুলে দেয়া হয়।
অ্যাম্বুলেন্সও সে সময় ইমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে পন্টুনে উঠে। কিন্তু সেই গাড়িটিকে না তুলে ফেরি ছেড়ে যায়।
পরে প্রায় ৪০ মিনিট পর হাওলাদারকে নামিয়ে দিয়ে ফেরিটি আবার ঘাটে এলে অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য গাড়ি পার করা হয়।
ফেরিতে উঠতে না পারার পর অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগী নুরুল আমিন মিথুনের খালা জেসমিন আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিথুন অসুস্থ অইলে পউট্টাহালি হাসপাতালে নিই। কিন্তু অর শ্বাসকষ্ট বাইর গেলে ডাক্তার অরে ঢাকায় নেতে কইছে। হেইয়ার জন্য ঢাকায় যাইতেছি। কিন্তু ফেরিতে ওঠতে পারলাম না। এহন এক ঘণ্টা এইহানে বইয়া থাকতে অইবে।’
অ্যাম্বুলেন্স রেখে এই ফেরিতে করেই নদী পার হয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার
মিথুন ঈদ উপলক্ষে পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার আঙ্গারিয়ায় মামার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এসেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পরেন বলে জানান তার খালা।
জেসমিন বলেন, ‘ফেরিঘাটে আইলে পন্টুনেনে উডি। কিন্তু ফেরির লোকজন মোগো উঠতে দিল না। মাত্র তিনডা গাড়ি নিয়া ফেরিডা ছাইড়া দিল।’
‘একটা গাড়ি নিলে ওনাগো কী ক্ষতি অইত?’-আক্ষেপের সুরে বলেন তিনি।
অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. রনি বলেন, ‘রোগী নিয়ে ফেরিতে উঠতে গেলে ফেরির লোকজন বাধা দিয়ে বলে ভিআইপি আছে, ওঠা যাবে না। আমি হর্ন বাজাইছি, কিন্তু উঠতে দিল না।’
এই প্রতিবেদন লেখার সময় মিথুনের অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকায় পৌঁছতে পারেনি। তখনও মাদারীপুরে ছিল গাড়িটি। আর তার খালা জানান, মিথুনের অবস্থাও ভালো নয় কোনোভাবেই।
রোগীর অ্যাম্বুলেন্স রেখে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফেরিচালক জয়দেব বলেন, ‘আমি উপরে থাকি। নিচ থেকে ছাড়ার সংকেত পেলে ঘাট ত্যাগ করি। কে ছিল আমি জানি না। সংকেত পাইছি তাই ছেড়ে গেছি।’
ফেরির লস্কর বাবুল বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতা ও রুহুল আমিন হাওলাদার স্যার ছিল, তাই ছেড়ে দিছি। তার সাথে থাকা লোকজন ছাড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিল। এ ছাড়াও ওই ফেরিতে একটি টুরিস্ট পুলিশের ভ্যান ছিল। তারাও ফেরিটি দ্রুত ছাড়তে বলেছে।’
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার
দুমকী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘শুনেছি ওই ফেরিতে জাপা নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার ছিলেন। ওই সময় সেখানকার দায়িত্বরত পুলিশ দুপুরের খাবার খেতে পাশে গেছিল। যে কারণে পুরো বিষয়টি জানা যায়নি।’
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির নেতা এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তিনি দুমকীর নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ গেছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টি নেতারা।
জনাব হাওলাদারের রাজনৈতিক জীবন বিএনপি দিয়ে শুরু হলেও পরে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। তিনি ২০০২ সালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মনোনীত হন। ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
দুই বছর পর ১৯ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে তাকে পুনরায় মহাসচিব পদে নিয়োগ দেন জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান।
যে রোগীকে রেখে হাওলাদার ফেরিতে উঠেন, সেই রোগী হাওলাদারের এলাকাতেই ঘুরতে গিয়েছিলেন।
দুমকীর আঙ্গারিয়া গ্রামের হাওলাদার ২০১৪ সালে পটুয়াখালী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ভোটে তিনি মনোনয়ন পাননি।
২০১৯ সালে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ উঠে। সে সময় ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড়ের পর ওই ঘটনায় বিআইডব্লিউটিসি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এই ঘটনায় পরে ঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন, ঘাটের প্রান্তিক সহকারী খোকন মিয়া এবং উচ্চমান সহকারী ও গ্রুপ প্রধান ফিরোজ আলমের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়া হয়। এ কারণে তিতাসের মৃত্যুর দায় এই তিনজন কিছুতেই এড়াতে পারেন না।