যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লাল মাংসের বাণিজ্য সীমিত করতে পারেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল গত সপ্তাহে। এমন কোনো পরিকল্পনা যে আসলে বাইডেন সরকারের নেই, তা পরে জানা গেলেও এর মধ্যেই সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেন বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির সদস্যরা।
বাইডেনের উদ্দেশে কলোরাডোর রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা লরেন বোয়েবার্ট বলেই বসেছিলেন, ‘আমার রান্নাঘর থেকে দূরে থাকুন আপনি।’
টুইটারে টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট লিখেছিলেন, ‘বাইডেন এবার আপনাদের গ্রিল বানাবেন।’
বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাইডেনের এমন কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের ডানপন্থি রাজনীতিকদের তীব্র মাথাব্যথার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমবার তারা দেশটিতে লাল মাংসের জনপ্রিয়তাকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে এসেছেন।
কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে লাল মাংস, বিশেষ করে গরুর মাংস। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে তৎপর ডেমোক্র্যাটরা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের খাদ্যাভ্যাস ও তাদের জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রিপাবলিকানদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য উৎপাদন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনীতিকে মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা রয়েছে। ফলে রাজনীতিতে খাদ্যাভ্যাস ঢুকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার প্রশ্নে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষি ও খামারভিত্তিক রাজ্যগুলোর মাংস খাওয়ার অধিকারের দাবি।
রিপাবলিকান পার্টির উপদেষ্টা মাইক মার্ফি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে মাংসের ওপর যুদ্ধ ঘোষণার কৌশলটি সাধুবাদ জানানোর মতো। বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক প্রশ্নে এটি যদি অপকৌশলও হয়, রাজনৈতিকভাবে এটি নিঃসন্দেহে কার্যকর।’
সম্প্রতি নেব্রাস্কার রিপাবলিকান গভর্নর পিট রিকেটস বলেন, ‘এ রাজ্যের জন্য সরাসরি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর আঘাত এই পদক্ষেপ।’
কয়েক মাস আগে রাজনীতিতে ইস্যুটি নিয়ে প্রথম সোচ্চার হন রিকেটস। মার্চে তার রাজ্য নেব্রাস্কার গবাদি পশুপালন ও মাংস বিক্রি থেকে আয় ছিল এক হাজার ২০০ কোটি ডলার।
কলোরাডোর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির গভর্নর জ্যারেড পলিস নিজ রাজ্যে রেড মিট জাতীয় মাংস খাওয়ার বিষয়ে জনগণকে অনুৎসাহিত করলে তার নিন্দা জানান রিকেটস।
গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে রেড মিট খাওয়া কমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন জ্যারেড পলিস।
রিকেটসের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান আইওয়ার রিপাবলিকান গভর্নর কিম রেনল্ডসও।
তিনি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাট আর উদারপন্থি সুবিধাবাদীরা আমাদের মাংস শিল্পকে বাতিলের তালিকায় নেয়ার পরিকল্পনা করছে।’
তবে বিষয়টি কেন্দ্রীয় রাজনীতি পর্যন্ত গড়ায় গত সপ্তাহে ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের জেরে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনলাইন থেকে সরিয়ে নেয়া প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকানোর লক্ষ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে আমেরিকানদের খাদ্যাভ্যাসে মাংসের পরিমাণ নির্ধারিত করে দিতে পারে বাইডেন সরকার।
খবরটি প্রকাশিত হতেই সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসও বাইডেন প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বলে সমালোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন রক্ষণশীল নেতারা।
খবরটি মিথ্যা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনে গবাদি পশুপালন শিল্পের প্রভাব কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে জনমনে।
২০১৯ সালে এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ১০ শতাংশের জন্য দায়ী কৃষিকাজ। এর মাত্র চার ভাগের এক ভাগের জন্য দায়ী মাংস বিক্রির উদ্দেশে গবাদি পশুপালন শিল্প।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগের কারণে অনেক আমেরিকান খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ সমর্থন করেন।
২০১৯ সালে গ্যালাপের জরিপে উঠে আসে, এক-চতুর্থাংশ আমেরিকান এক বছর আগের তুলনায় কম মাংস খাচ্ছেন। মূলত নিজেদের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নিলেও পরিবেশগত উদ্বেগও অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন অনেক আমেরিকান।
মাংস খাওয়া কমানো ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ডেমোক্র্যাট আর ১২ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক।
আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির কৃষিবিষয়ক অর্থনীতিবিদ শ্যাড হার্ট বলেন, গরুর মাংস না খাওয়ার কথা অনেক আমেরিকান চিন্তাই করতে পারে না। তাদের জন্য বিষয়টি কেবল রাজনীতির অংশ।
গরুর মাংস আমেরিকানদের আবেগের যে স্থানে আছে, মুরগী কিংবা শূকর নিয়ে তাদের ততটা মাথাব্যথা নেই বলেও জানান হার্ট।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে খাবারের টেবিলের কেন্দ্রে থাকে গরুর মাংস। তারপর অন্যকিছু। অনেকের কাছে তাদের প্রতি বেলার খাদ্যতালিকা একদম জাতীয় পরিচয়ের মতো।’
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক যুদ্ধের রাজনীতিতে খাদ্য নতুন বিষয় নয়।
সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা আমেরিকানদের ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার চর্চা করছেন বলে রক্ষণশীলদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থায়নে দেয়া খাবারে পুষ্টিগুণ নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছিলেন মিশেল।
২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকাকালীন বারাক ওবামার বিরুদ্ধেও খাদ্য নিয়ে আভিজাত্য ও শ্রেণিবৈষম্যের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। আইওয়াতে একদল কৃষককে আরুগুলা শাকের দাম নিয়ে প্রশ্ন করে বিরোধীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। যদিও রাজ্যটিতে দলীয় মনোনয়নের বাছাইপর্বে সে সময় উৎরে গিয়েছিলেন তিনি।
অতীদে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের বিচ্ছিন্নতা প্রদর্শনে খাদ্যকে হাতিয়ার করার প্রবণতা ছিল রিপাবলিকানদের। কালে কালে সে প্রশ্ন এসে ঠেকেছে জলবায়ু আর অর্থনীতিতে।
মাংস খাওয়াকে অনুৎসাহিত করার আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রে জোরদার হচ্ছে সাম্প্রতিককালে। মাংসের বিকল্প পণ্যের বাজারও তৈরি হচ্ছে দেশটিতে।
এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন জরুরি কর্মপরিকল্পনার কথা বললেও এখনও এতে অনুমোদন দেয়া বা এর বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। তাও মাংসের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের যুদ্ধের কথিত পরিকল্পনা ঠেকাতে নানারকম পদক্ষেপ নিচ্ছে রিপাবলিকানরা।
এপ্রিলে আইওয়ার পার্লামেন্টে একটি বিল উপস্থাপন করে রিপাবলিকানরা। সরকারি কর্মীদের মাংস বরাদ্দ নিষিদ্ধে বাইডেন প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিলে অঙ্গরাজ্যে সেটির প্রয়োগ ঠেকাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে বিলটিতে।
মার্চে নেব্রাস্কায় ‘খাদ্যতালিকায় মাংস দিবস’ ঘোষণা করেন রিকেটস। এ ছাড়া গত বুধবারই মে মাসকে ঘোষণা করেন ‘মাংসের মাস’ হিসেবে।
তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই যুক্তরাষ্ট্রের গবাদি পশুপালন শিল্পে জড়িতদের।
দেশটির ন্যাশনাল ক্যাটলমেন’স বিফ অ্যাসোসিয়েশনের (এনসিবিএ) অভিযোগ, শিল্পের অভ্যন্তরীণ সংকট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না রাজনীতিকরা। মহামারি, খরা, পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কীভাবে পাল্লা দিচ্ছে কসাইখানাগুলো, তা নিয়ে কোনো নেতা কিছু ভাবছেন না।
এনসিবিএর মুখপাত্র সাইগ্রিড জোহানেস বলেন, ‘মানুষের আবেগ আর বাগযুদ্ধ নিয়েই দুই পক্ষের রাজনীতিকরা ব্যস্ত। আমরা ব্যস্ত আমাদের লক্ষ্য অর্জনে। খাদ্য নিয়ে লড়াই থেকে তাই দূরেই থাকছি।’