জামায়াত থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠার এক বছরে সারা দেশের সব জেলাতে কমিটিও গঠন করতে পারেনি ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ যা সংক্ষেপে এবি পার্টি নামে পরিচিত।
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪১টিতে কেবল আহ্বায়ক কমিটি করতে পেরেছে দলটি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি কোথাও। কেন্দ্রীয় কমিটিও পূর্ণাঙ্গ হয়নি এই এক বছরে।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী থেকে বের হয়ে এসেছেন। তারা দাবি করছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গ্লানি আর এই প্রজন্মের বহন করার মানে হয় না। তাই সেই দল থেকে বের হয়ে আসা।
নেতা-কর্মী আর সমর্থক হিসেবে এখন পর্যন্ত এবি পার্টির মূল লক্ষ্য সেই জামায়াতই। আর আশা অনুযায়ী বিকশিত হতে না পারার জন্য দায়ী করছে সেই জামায়াতকেই।
২০২০ সালের ২ মে দলটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে দলটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি সাবেক সচিব ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর জামায়াতের পেশাজীবীদের সংগঠন জাতীয় পেশাজীবী ফোরামের নেতৃত্ব দিতেন। কুমিল্লা-৯ আসনে দলের প্রার্থীও ছিলেন।
দলের সদস্যসচিব হয়েছেন মুজিবুর রহমান মঞ্জু, যিনি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছেন এককালে।
দলটি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়ার দিন সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জু বলেন, ‘আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর।’
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিনটি বিষয় রাখা হয়েছিল দলটির ঘোষণাপত্রে।
তবে এই এক বছরে আলোচনায় আসতে পারেনি দলটি। বলার মতো কোনো কর্মসূচিও ছিল না। আর ভিন্নধর্মী কোনো বক্তব্যও আসেনি দলটির পক্ষ থেকে। তাদের কর্মসূচিতে নানা সময় বক্তব্য রেখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যিনি ইদানীং নানা সংগঠনের কর্মসূচিতেই যাচ্ছেন, অনেকটা বিরোধী পক্ষের কণ্ঠস্বরের মতো হয়ে উঠেছেন।
কেন এগোতে পারছে না এবি পার্টি?
সচিব বলেন, তার আগের দল জামায়াতে ইসলামী তাদের নেতা-কর্মীদের ঘেঁষতে দিতে চাচ্ছে না। তবে অনেক নেতা-কর্মী যোগদানে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘জামায়াত তো আমাদের বিরুদ্ধে একটা সার্কুলার জারি করেছে। আমাদের সঙ্গে যাতে কেউ দেখা না করে, কথা না বলে, আমাদের ধারেকাছেও যাতে কেউ না ঘেঁষে।’
কবে জামায়াত এমন সার্কুলার জারি করেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের আমির একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন তাদের (এবি পার্টি) সাথে যোগাযোগ রাখা যাবে না।’
অর্থাৎ বিকাশের জন্য জামায়াতের নেতা-কর্মীর ওপরই নির্ভর করছে এবি পার্টি। জামায়াত থেকে বের হয়ে আরও একটি জামায়াত হলে পার্থক্যটা কী হবে?
এমন প্রশ্নে মঞ্জু অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা। বলেন, ‘বিভিন্ন পেশা-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে যারা রাজনীতিতে আগ্রহী তাদের সমন্বয়ে আমরা দল গঠন করতে চাই। যেমন আমাদের এখানে নারীরা আসতেছে, এই নারীরা তো কেউই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত না।’
তবে অন্যদের যে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না, তা কেবল ৪১টি আহ্বায়ন কমিটি গঠনের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট।
তবে মঞ্জু দাবি করেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে কমিটি দেয়ার কাজ শেষ হবে।
অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে কিছুটা ধীরে কাজ হচ্ছে।’
সরকার বাধা দিচ্ছে বলেও দাবি করেন মঞ্জু। বলেন, ‘সরকার আমাদের সভা-সমাবেশ করার পারমিশন দেয় না। বহু জায়গায় আমরা মিটিং করতে গেছি, পুলিশ অনুমতি দেয়নি। …গভর্নমেন্ট করোনার ক্রাইসিসটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে।’
তবে গত বছরের নভেম্বর থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করেছে। কিছু সভা হয়েছে এবি পার্টিরও।
ব্যারিস্টার রাজ্জাককে নিয়ে আলোচনা
দলের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীকে গত ২ মে দলের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক তাদের দলের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে রাজ্জাক একটি পরিচিত নাম। পাশাপাশি তিনি জামায়াতের বৈদেশিক শাখার দেখভাল করতেন। এবি পার্টি আশা করছে, রাজ্জাক দেশের বাইরে জামায়াতকে যেভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করেছেন, এবার তাদের হয়ে সে কাজটি করবেন।
জামায়াত নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, আবদুস সুবহান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, গোলাম আযমদের রক্ষায় উচ্চ আদালতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তবে দলের সঙ্গে মতবিরোধে একপর্যায়ে তিনি মামলা শেষ না করেই দেশের বাইরে দলে যান।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর রাজ্জাক তার দলের নেতাদের ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন বলে নানা সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এমনও খবর এসেছে যে, তিনি জামায়াতকে বিলুপ্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক দেশে ফিরবেন কি না, এ বিষয়ে এবি পার্টির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য আসেনি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন জানালেও তার সঙ্গে আর কেউ নেই।
সদস্যসচিব মঞ্জু বলেন, ‘আমরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উপদেষ্টা পরিষদ করিনি। যখন দলের সম্মেলন করব তখন ফর্মালি কমিটি করব। যারা আমাদের নিয়মিত মিটিংয়ে আসেন ওয়ার্কশপগুলোতে থাকেন তাদেরকেই উপদেষ্টা হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করব।’