কমিটি বিলুপ্ত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দিল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকেই এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
আগের কমিটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদীকে আহ্বায়ক কমিটির মহাসচিব আর সিনিয়র নামেবে আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা।
সদস্য করা হয়েছে আল্লামা সালাহউদ্দীন নানুপুরী ও মিজানুর রহমানকে (পীরসাহেব দেওনা)।
হেফাজতের সাম্প্রতিক তাণ্ডবের পর শুরু হওয়া গ্রেপ্তার অভিযান ও সমঝোতার জন্য হেফাজতের মরিয়া চেষ্টার মধ্যে রোববার রাতে হেফাজতের কমিটি ভেঙে দেয়ার ঘোষণা আসে অনেকটা আচমকা।
রাত ১১টার দিকে জুনায়েদ বাবুনগরী এক ভিডিওবার্তায় এসে বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন, দ্বীনি সংগঠন ইমান আকিদার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটিকে বিলুপ্ত… কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের পরামর্শক্রমে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো।
‘ইনশাআল্লাহ আগামীতে আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে আবার হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম শুরু হবে।’
এরপর রাত সোয়া দুইটার দিকে নিউজবাংলাকে আহ্বায়ক কমিটি করার কথা নিশ্চিত করেন নতুন আহ্বায়ক কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী ইনআমুল হাসান ফারুকী। পরে হেফাজতে ইসলামের ফেসবুক পেজেও কমিটি গঠনের তথ্য আপলোড করা হয়।
সমঝোতায় মরিয়া ছিল হেফাজত
১৮ এপ্রিল যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক গ্রেপ্তারের পরদিন ১৯ এপ্রিল ভিডিওবার্তায় এসে বাবুনগরী ‘মাননীয় সরকার’ উল্লেখ করে গত ২৬ মার্চের তাণ্ডবের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। যদিও এর আগে তিনি কোনো সহিংসতায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছিলেন।
একই দিন ৯ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়ে নুরুল ইসলাম জেহাদী যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায়। আহ্বান জানান সমঝোতার। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন গ্রেপ্তার অভিযান চলবে।
এরপর ২৩ এপ্রিল আবার বিবৃতি দিয়ে আলোচনার জন্য আকুতি জানান হেফাজত মহাসচিব। এমনও বলেন, হেফাজতের ভেতরে কেউ অপতৎপরতা চালালে তারা নিজেরাই ব্যবস্থা নেবেন।
মার্চের সহিংসতাকে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা উল্লেখ করে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন হেফাজত মহাসচিব। বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল বলে আমরা মনে করি।’
তবে এই বিবৃতি দেয়ার দুই দিন পর ২৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন নায়েবে আমির আহমাদ আবদুল কাদের।
হঠাৎ করেই তাণ্ডব
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২৬ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসাসংলগ্ন মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে স্থানীয় ডাকবাংলো ও এসিল্যান্ড অফিসে হামলা করেন হেফাজত কর্মীরা। আক্রমণ হয় থানাতেও। তখন পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন চারজন।
একই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হামলা ছিল আরও ব্যাপক।
সেদিন স্থানীয় রেলস্টেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় ও আনসার ক্যাম্প আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও। পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন একজন।
এর প্রতিবাদে ২৮ মার্চ হরতাল ডাকে সংগঠনটি।
শান্তিপূর্ণ হরতালের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেদিন তাণ্ডব ছিল ভয়াবহ। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যে সহিংসতা চালানো হয় তাতে আঁতকে ওঠে মানুষ।
জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, ভূমি অফিস, গ্যাস বিতরণ সংস্থার কার্যালয়ের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের যত স্মৃতিচিহ্ন ছিল বেছে বেছে হামলা হয় সব জায়গায়। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, বাদ যায়নি কিছুই।
একই দিন নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জেও ব্যাপক সহিংসতা চালায় তারা। আক্রমণ হয় সাংবাদিকদের ওপরও।
আওয়ামী লীগের ওপর আক্রমণ
সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের অফিস, সরকার সমর্থকদের বাড়িঘরেও হামলা চলতে থাকে।
৩ এপ্রিল হেফাজত নেতা মামুনল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে এক নারী নিয়ে অবরুদ্ধ হন স্থানীয়দের হাতে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়া মামুনুলকে উদ্ধার করতে গিয়ে হেফাজত কর্মীরা ত্রাস চালান সেখানে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, ছাত্র ও যুবলীগ নেতাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়িতেও চলে বেপরোয়া ভাঙচুর।
একই দিন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, সুনামগঞ্জের ছাতকে আওয়ামী লীগের কার্যালয় হয় আক্রান্ত।
গ্রেপ্তার অভিযান
পরদিন সংসদে হেফাজতকে সতর্ক করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এর এক সপ্তাহ পর শুরু হয় গ্রেপ্তার অভিযান।
১১ এপ্রিল ধরা পড়েন হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। সে সময়ও বোঝা যায়নি গ্রেপ্তার অভিযান এত লম্বা হবে।
এরপর একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকেন বেশ কয়েকজন সহকারী মহাসচিব, সহপ্রচার সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আর ১৮ এপ্রিল ধরা পড়েন আলোচিত নেতা মামুনুল হক।
এই অভিযান শুরুর পরই হেফাজতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
হেফাজতের উত্থান যেভাবে
২০১০ সালে নারীনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে কওমি ঘরানার সব দল ও সংগঠন মিলে গঠন করে হেফাজতে ইসলাম। আমির করা হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান শাহ আহমদ শফীকে। কওমি আলেমদের মধ্যে তিনি মুরব্বি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তবে সংগঠনটি আলোচিত হয়ে ওঠে ২০১৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে।
ওই বছর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণমঞ্চ নামে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই আন্দোলনের নেতাদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের ফাঁসি দাবি করে হেফাজত। তারা নানা কর্মসূচি দিয়ে ৫ মে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয়।
সেদিন বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের পর হঠাৎ করে বিকেলে সংগঠনটি শাপলা চত্বরে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। আর বিকেলে সেখানে জড়ো হওয়ার পর সেখান থেকে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করে। একপর্যায়ে তারা সরকার পতনের দাবি করতে তাকে।
দিনভর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালান হেফাজত কর্মীরা। ওই সমাবেশে অংশ নিয়ে পরদিন থেকে নতুন সরকারের ঘোষণাও দেয়া হয়।
সেই সমাবেশকে ঘিরে হেফাজত সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছিল বলে হেফাজতের গ্রেপ্তার এক নেতা আদালতে জানিয়েছেন। তিনি জানান, বিএনপির এক নেতা তাদের পাঁচ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সেই নেতা হলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু।
যদিও হেফাজতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে হেফাজত যখন শাপলা চত্বরে অবস্থান করে, সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার কর্মী-সমর্থকদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। যদিও বিএনপির সেই স্বপ্ন সে সময় পূরণ হয়নি।
ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে হেফাজত কর্মীরা শাপলা চত্বর ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আর অভিযানের পর হাজার হাজার মানুষকে হত্যার গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
বিএনপি ঘরানা ত্যাগ করে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক
যদিও পরে কারও নাম দিতে পারেননি হেফাজত আর সংগঠনের সে সময়ের শীর্ষ নেতারা। পরে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গ ত্যাগ করে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
এর একপর্যায়ে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে কওমি অঙ্গনের দীর্ঘ বছরের দাবি পূরণ করে সরকার। এই সনদের স্বীকৃতির আশায় ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিল কওমি রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ইসলামী ঐক্যজোট।
পরিস্থিতি পাল্টে যায় গত সেপ্টেম্বরে
গত সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামায় আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতি আবার ঘোলাটে হয়।
গত ১৫ নভেম্বর বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের ইসলামের ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
সংগঠনটি বরাবর নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করে এলেও এই ১৫১ জনের সিংহভাগেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আর এদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক।
এবার কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ২০-দলীয় জোট ছেড়ে আসা দলগুলোর নেতাদের বাদ দেয়ার পরই হেফাজতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মাওলানা রুহুল আমিন দুটি কওমি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাকেও কোনো পদে রাখা হয়নি, যদিও বাকি চারটি বোর্ডের চেয়ারম্যানদের রাখা হয়েছে।
রুহুল আমিন আওয়ামী ঘনিষ্ঠ আলেম হিসেবে পরিচিত। তিনিও কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
বাদ পড়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামী ঐক্যজোটর মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ। তিনি আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
তবে ২০ দল ছাড়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে অন্য দলে যোগ দেয়া জুনায়েদ আল হাবিবকে ঠিকই কমিটিতে রাখা হয়েছে।
রাজনীতি নিয়ে নাক গলানো শুরু
হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন হওয়ার পরেই সংগঠনের নেতারা রাজনৈতিক বিষয়ে নানান বক্তব্য দিতে থাকেন।
হেফাজত নেতারা নানা সভা-সমাবেশ ও ওয়াজে বলতে থাকেন, তাদের কথা শুনে দেশ চালাতে হবে। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তারা। এমন বক্তব্যও আসে যে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে, তা টেনে ফেলে দেয়া হবে। আবার শাপলা চত্বর পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।
তবে হেফাজত সহিংস হয়ে ওঠে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে।
মোদি ঠেকাতে হঠাৎ করেই মাঠে নামে সংগঠনটি। যদিও সফরের চার দিন আগে ২২ মার্চ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি ঘোষণা দেয়, মোদির সফরের বিরোধী হলেও তারা কোনো কর্মসূচি দেবে না।
তবে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ২৫ মার্চ বায়তুল মোকাররমের সামনের সমাবেশে ঘোষণা করেন, মোদি দেশে এলে সরকার পতনের ক্ষেত্র তৈরি করবেন তারা।