২০১৩ সালের ৫ মে জোট বেঁধে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল হেফাজতে ইসলাম-জামায়াতে ইসলামী-বিএনপির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী, হেফাজতের ১৩ দফা দাবি নিয়ে শাপলা চত্বরে তাণ্ডব চালানো হয়।
পুরো কার্যক্রমে বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক নেতা অর্থ দিয়েছিলেন। এদের একজন হলেন বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি কয়েক কোটি টাকা দিয়েছিলেন বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম।
হেফাজতের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান মুফতি ফখরুল ইসলামকে গত ১৪ এপ্রিল লালবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশের বিশদ তদন্তে এই তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির আগে কয়েক দফা বৈঠক হয় হেফাজত ও বিএনপি নেতাদের। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও এক জামায়াত নেতার সঙ্গে হেফাজত নেতাদের বৈঠক হয়েছিল। খোকার বাসা ও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসে ওই বৈঠক হয়।
ওই দুই বৈঠকে হেফাজত নেতাদের আন্দোলন পরিচালনার জন্য টাকা দেয়া হয়। সেই টাকার একটি বড় অংশ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি কয়েক কোটি টাকা দেন বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। হেফাজতের কোন কোন নেতার হাতে মিন্টু সেই অর্থ দিয়েছিলেন, জানতে চাইলে তদন্তের স্বার্থে সে তথ্য দেননি মাহবুব আলম।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু
দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু অনেকগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি এ দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তাকে বিএনপির অনানুষ্ঠানিক তহবিলদাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়।
৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার ঘটনায় আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের কাজে বাধা ও ভাঙচুরের ঘটনায় পাঁচটি মামলা করেছিল পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বের হওয়ার পর মিন্টু গ্রেপ্তার হয়ে পরে জানুয়ারি মাসে জামিনে মুক্ত হন।
এ বিষয়ে কথা বলতে বুধবার আব্দুল আউয়াল মিন্টুর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারি পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, ‘স্যার গত এক মাস ধরে দেশের বাইরে আছেন।’
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম আরো জানান, ‘মূলধারার যেসব রাজনৈতিক দল হেফাজতের সঙ্গে আছে, যেমন বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী– তাদের সঙ্গে যোগসাজশ আমরা পেয়েছি। ২০১৩ সালের ষড়যন্ত্রে বিএনপির কয়েকজন নেতার যোগসাজশ প্রমাণিত।’
সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে হেফাজতের যে তাণ্ডব, তার পেছনে এ দলগুলোর একই রকম আঁতাত আছে বলে মন্তব্য করে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই পরিকল্পনা হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সমসাময়িক কোনো বৈঠকে হয়েছে, নাকি আগের ২০১৩ সালের মিটিংয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলছে, সেটা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে ফান্ড আসে। কোন কোন দেশ থেকে তাদের এই অর্থ আসে, কারা পাঠান– এগুলো আমরা তদন্ত করে দেখছি। সেই সঙ্গে লন্ডন ও কানাডা থেকে সম্প্রতি কোনো ফান্ড এসেছে কিনা, সেটাও যাচাই করা হচ্ছে।’
যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, ৫ মের ঘটনার আগে আগে বিএনপি চেয়ারপারসনসহ অনেকের সঙ্গে হেফাজতের তখনকার মহাসচিব (বর্তমানে আমির) জুনায়েদ বাবুনগরীর বৈঠক হয়েছিল। সেসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, শাপলা চত্বরে তাণ্ডব স্থায়ী হলে বিএনপি-জামায়াত তাতে যোগ দেবে।
‘নাস্তিক’ব্লগারদের শাস্তি ও ভাস্কর্য বানানো বন্ধসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে লংমার্চ করে ঢাকায় এসে মতিঝিলে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগে চলমান গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করেই দৃশ্যত হেফাজত এ কর্মসূচি দিয়েছিল। কর্মসূচি চলাকালে খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বিকেল ৩টায় মঞ্চে এসে হেফাজতের কর্মসূচি ও দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও দলে তখনকার সহ-সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা (প্রয়াত)।
ওই সমাবেশ থেকে নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে ফিরে খন্দকার মোশাররফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসলাম ও প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.) এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে এদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই সমাবেশে এসেছে। আমরাও এই সমাবেশের দাবির প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করেছি।’
এর আগের দিন বিএনপি হেফাজতের এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানায় ও লংমার্চে বাধা দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে সেটার নিন্দা জানায়।
হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের পর শাপলা চত্বর। ছবি: নিউজবাংলা
মুফতি ফখরুল জবানবন্দিতে যা বলেছেন
হেফাজত নেতা মুফতি ফখরুল ইসলামকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের এসব তথ্য দেন তিনি। রিমান্ড শেষে গত ১৯ এপ্রিল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ফখরুল।
জবানবন্দিতে তিনি ২০১৩ সালের ৫ মের সহিংসতার বিষয়ে বলেন, ওইদিন তিনি কারাঙ্গীরচর মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার ৮-১০ হাজার হেফাজত কর্মী-সমর্থক নিয়ে লালবাগ-চকবাজার হয়ে নয়াবাজারে আসেন। জোহরের নামাজের পর দুপুর ২টার দিকে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেব ফোন দিয়ে সবাইকে নিয়ে শাপলা চত্বরে যাওয়ার জন্য বলেন।
শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় গোলাপশাহ মাজারের সামনে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন। সেখানে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর ৩টার দিকে শাপলা চত্বরে পৌঁছান। শাপলা চত্বরে গিয়ে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহ রব ইউসুফি, জুনায়েদ আল হাবিব, মামুনুল হক, মাওলানা জাফর উল্লাহসহ অন্যান্য নেতাদের দেখতে পান। মামুনুল হকসহ অন্যান্য হেফাজত নেতারা তাদের ১৩ দফা দাবি আদায় না করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলন করা হবে বলে তাকে জানিয়েছিলেন।
মুফতি ফখরুল তার জবানবন্দিতে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য দেন। তিনি বলেন, আন্দোলন পরিচালনা করতে বিএনপির দুই জন ও জামায়াতের একজন নেতা হেফাজতকে অর্থ দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, আন্দোলনের এক সপ্তাহ আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে জুনায়েদ বাবুনগরীর বৈঠক হয়েছিল বলে মুফতি ফখরুল। আর এসব তথ্য তিনি জেনেছিলেন হেফাজত ও ইসলামি ঐক্যজোটের যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহীর কাছ থেকে।