দেরিতে হলেও সরকার হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, তিনি আশা করছেন ধর্মভিত্তিক এই গোষ্ঠী যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত হানতে না পারে, সেই ব্যবস্থা সরকার করবে।
শুক্রবার নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের এ কথা বলেন মন্ত্রী। ওয়েবিনারের বিষয় ছিল: ‘জামায়াত-হেফাজত চক্রের বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা, সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়।’
হেফাজত জাতীয় সঙ্গীত মানে না, জাতির পিতাকে মানে না, সংবিধান মানে না উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘তাদের ছাড় দেয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।’
কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে। দুই দিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় তাদের ত্রাস তৈরি করে উদ্বেগ।
বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের প্রতিবাদ জানিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
এরপর ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পরও ব্যাপক সহিংসতা চালায় সংগঠনটি। এরপর হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজতের তাণ্ডব ও কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত পরিষ্কার যে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। স্বাধীনতা মানে না বলেই তারা সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান বানচাল করার চেষ্টা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করা।’
তিনি বলেন, ‘এবার তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বানচাল করার জন্যই মোদির বিরোধিতার কথা বলে সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে। বিলম্বে হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা যেন ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করতে না পারে সে ব্যবস্থাই সরকার করবে বলে আমি আশা করি।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবারের আগেও দুইবার বাংলাদেশে এসেছিলেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তখন হেফাজতকে কোথাও দেখা যায়নি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেল স্টেশন পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। ছবি: নিউজবাংলা
নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘জামায়াত ও হেফাজতকে পৃথক দল কিংবা পরস্পরবিরোধী মনে করার কোনো কারণ নেই। হেফাজতের ১৩ দফা জামায়াতেরই পুরনো দাবি।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান অর্থবহ করতে হলে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে হলে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘ভবিষ্যতে তারা (হেফাজত) সকল ইসলামিক দলগুলোকে এক জায়গায় এনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করবে এবং বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। এসব বিষয়ে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সর্বনাশের বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা হেফাজতের তাণ্ডব ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলগুলোর ভেতর হেফাজতের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হবে এবং বিভ্রান্তি দূর করতে হবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘হেফাজত ও জামায়াত ধর্মের লেবাসধারী পাকিপন্থার নব্য রাজাকারচক্রের সংগঠন। তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দেয় ও তারা দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে। তারা প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় এবং গোপনে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, দেশবিরোধী। কখনও প্রকাশ্যে কখনও সশস্ত্রভাবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সন্ত্রাসের দায়ে হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হকসহ সব নেতাদেরকে গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে- এমন দাবি করে তিনি বলেন, ‘সকল মাদ্রাসাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সকল মসজিদে রাজনৈতিক বক্তব্য নিষিদ্ধ করতে হবে।’
কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘হেফাজত যদি রাজনৈতিক দল হয়ে থাকে, তাহলে মাদ্রাসায় বাচ্চাদের ভর্তি করে আমরা কেন তাদের সদস্য তৈরি করে দিচ্ছি? মাদ্রাসাগুলো থেকে আমরা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছি না। দারিদ্র্যতার কারণে বাবা-মা তাদের কোমলমতি শিশুদের মাদ্রাসায় পাঠায়। আমরা দরিদ্র মা-বাবাদের সন্তানের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-হোস্টেল এগুলো তৈরি করছি না। এ বিষয়গুলো আমাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থায় রাখতে হবে।’