দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড স্থগিতের পর গুলশান-২ এর বাসায় ফিরে একদিনের জন্যও বাইরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। করোনাভাইরাসের ঝুঁকির বিবেচনায় নিকটজন ছাড়া দলীয় শীর্ষ নেতাদের সংস্পর্শও এড়িয়ে চলেছেন তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যখন বাসায় গেছেন, প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থাই নিয়েছেন।
তারপরেও বিএনপি নেত্রী ছাড়াও সেই বাসার ২০ থেকে ২২ সদস্যের মধ্যে নয় জনেরই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
তাদের মধ্যে রয়েছে গাড়িচালক জালাল, বাবুর্চি রতন, গৃহপরিচিকা ফাতেমা, রুপা ও স্টাফ খায়ের।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক আল মামুনের ধারণা, গৃহপরিচারিকা ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী ফাতেমার কাছ থেকেই সংক্রমণ হয়েছে বিএনপি নেত্রীর।
কেন এই ধারণা করছেন- জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ফিরোজার কেয়ারটেকারদের করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে তাদের কয়েকজনের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। কেয়ারটেকারদের করোনা পজিটিভ এলে খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী ফাতেমারও নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তখন তারও করোনা পজিটিভ আসে।
‘তখনই আমাদের সন্দেহ হয়। তারপরই ম্যাডামের করোনা টেস্টের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যেটা পজিটিভ এসেছে।’
ফাতেমা আলোচিত ও পরিচিত হন ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে।
ফাতেমা পুরোটা সময় বিএনপি নেত্রীর সঙ্গী হিসেবে কারাগারে ছিলেন। তার ব্যক্তিগত কাজ করে দেয়ার পাশাপাশি সেবা সুশ্রুষা করেছেন। বন্দি না হয়েও কারাগারে থাকার কারণে তার প্রতি সহমর্মিতাও স্পষ্ট।
কারাগারেও বিএনপি নেত্রীর সেবা করেছেন গৃহপরিচারিকা ফাতেমা
কারাগার থেকে ফেরার পরেও ফাতেমাই বিএনপি নেত্রীর সব সময়ের সঙ্গী হয়ে রয়েছেন। তার সাহায্য ছাড়া খালেদা জিয়ার পক্ষে চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া, ওষুধ সেবন কঠিন। দীর্ঘদিনের অভ্যস্থতা বলে অন্য কাউকে তার জায়গায় আনতেও চাইছিলেন না বিএনপি নেত্রী।
তবে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন তার দেখভালের দায়িত্ব গেছে নার্সদের হাতে। বিশ্রামে আছেন ফাতেমাসহ অন্যরা।
তবে ফাতেমার মাধ্যমেই খালেদা জিয়া সংক্রমিত হয়েছেন- এমন সিদ্ধান্তে আসতে চান না বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম ঘর থেকে বের না হলেও ওনার বাসায় যে স্টাফ রয়েছেন, তারা তো যাতায়াতের মধ্যে রয়েছেন। বাজারঘাটের একটা বিষয়ও আছে। আর করোনা এমন জিনিস, এটা কীভাবে, কার শরীরে জায়গা করে নিচ্ছে, তা বলা মুশকিল।’
করোনা সংক্রমণের কথা অস্বীকার ‘ইমানি দায়িত্বের কারণে’
খালেদা জিয়ার করোনা পজিটিভ আসার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেয়া হলেও দল থেকে প্রথমে তা নাকচ করে দেয়া হয়।
চিকিৎসক আল মামুন শনিবার নমুনা সংগ্রহের বিষয়টিও জানতেন। কিন্তু সেটি তিনি অস্বীকার করেছেন। পরদিন যখন নমুনা পরীক্ষার ফল এসেছে, তখনও সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন।
কেন এমন করলেন- এমন প্রশ্নে মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে আমি ইমানি দায়িত্ব পালন করেছি। রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা আমার দায়িত্ব।’
তবে আল মামুন এখন সব খুলে বলছেন দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরে সংবাদ সম্মেলনের পর। রোববার বিকালে তিনি গণমাধ্যমের সামনে এসে সংক্রমণের তথ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানান।
বিএনপি নেত্রীর ডায়াবেটিসসহ আরও নানা জটিল রোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে তার দল
খালেদার কোমরবিডিটি নিয়ে উদ্বেগ
যেসব রোগ করোনা রোগীদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, তার বেশ কয়েকটি আছে বিএনপি চেয়ারপারসনের। এসব রোগকে বলে কোমরবিডিটি।
বয়স, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও আর্থ্রাইটিস এবং আরও নানা জটিলতার কথা গত দুই বছর ধরে বলে আসছিলেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা তো খুব ভালো না। তিনি অসুস্থ।
‘করোনা সুস্থ মানুষকেই কাবু করে দেয়, সেখানে তিনি তো অসুস্থ, তার পক্ষে তো আর লড়াই করা সম্ভব না। এখন ওনার জন্য দোয়া করা ছাড়া বিকল্প নেই।’
মনে শক্তি রাখার পরামর্শ জাফরুল্লাহর
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ধারণা, খালেদা জিয়ার মানসিক শক্তি কমে গেছে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় তার মানসিক বলটা একেবারেই নেই। যেভাবে তাকে বন্দিদশায় রেখেছে, চাপ সৃষ্টি করে কোণঠাসা করা হয়েছে, সেখানে ওনার শারীরিক থেকেও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ।
‘আমরা যারা সুস্থ, তারাও লড়াই করে যেখানে পেরে উঠছি না, সেখানে ওনার তো লড়াইয়ের সুযোগ নেই। ওনার মেন্টাল হেলথ ইজ নট গুড। এটাই হলো মূল কারণ।’
ফিরোজায় খালেদা জিয়ার এক বছর
দুই বছর এক মাস ১৯ দিন বন্দিদশায় থাকার পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় যান খালেদা জিয়া।
করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারের আবেদনে সাড়া দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রথমে ছয় মাসের জন্য মুক্তিতে সায় দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে পরে মুক্তির মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়।
সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশান-২ এর বাসভবন ফিরোজায় যাওয়ার পর আর বের হননি খালেদা জিয়া
ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শর্ত অপরিবর্তিত রেখে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ায়।
চলতি বছরে ২৪ মার্চ বর্ধিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তার আরও ছয় মাস স্থগিত করা হয়েছে খালেদা জিয়ার দণ্ড।