ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দেশবাসী প্রথম প্রত্যক্ষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে সেদিন মতিঝিলের শাপলা চত্বরের চারপাশে বিজয়নগর, পল্টন ও গুলিস্তানের কয়েক বর্গমাইল এলাকায় দিনভর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে হেফাজত কর্মীরা।
সেই সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শুধু ঢাকাতেই মামলা হয়েছিল ৫৩টি। হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয় সেসব মামলায়। চারটি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। আরও দুটি মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া অন্য ৪৭টি মামলার তদন্ত একেবারেই স্থবির। ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার হলেও আট বছর ধরে জামিনে আছেন হেফাজতের এখনকার আমির জুনাইদ বাবুনগরী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম অবশ্য সেটা মানতে নারাজ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত কার্যক্রম থেমে নেই। আসামির সংখ্যা বেশি বলে যাচাই-বাছাই করে তদন্ত শেষ করতে সময় বেশি লাগছে। কিছু আসামি আমরা সেই সময় শনাক্ত করতে পারিনি। কিন্তু সমসাময়িক কিছু ঘটনায় তাদের শনাক্ত করা গেছে। তা ছাড়া অনেক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। সবকিছু পর্যালোচনা করে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।’
আবার রাজধানীর কলাবাগান থানার দুটি, রমনার একটি, শেরেবাংলা নগর থানার একটিসহ মোট চারটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হলেও সেগুলোর বিচারকাজে কোনো ধরনের অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তারা।
বিচারকাজে ধীরগতির কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা না পড়লে বিচারকাজ শুরু হবে কীভাবে? সঠিক সময়ে মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হলে এতদিনে নিশ্চয়ই বিচার শুরু হয়ে যেত, আর হেফাজত আবারও এতটা সহিংসতা করার সাহস পেত না।’
চারটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পরও সে মামলাগুলোর বিচারকাজ কেন শুরু হচ্ছে না জানতে চাইলে আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘সেটা বিচারিক আদালতের বিষয়।’
যা ঘটেছিল ৫ মে ২০১৩
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এসব দাবিতে ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক।
ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে অবস্থান নেন হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মীসমর্থক। ছবি: সংগৃহীত
এ সময় মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশ এলাকায় শত শত দোকান, ফুটপাথের লোহার বেষ্টনী, আশপাশের অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলেন হেফাজতের কর্মীরা। সমাবেশকে কেন্দ্র করে ওই দিন রাজধানীর পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে হেফাজত নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
ওই রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় হেফাজতের কর্মীদের। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হয়েছিলেন। সেসব ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জে ৮৩টি মামলা হয়। সেসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৮৪ হাজার ৭৯৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর হেফাজতের নেতাকর্মীরা দুই হাত উঁচু করে বের হয়ে আসে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
মামলার আসামি কারা
৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে নিহত হন পুলিশের উপপরিদর্শক মো. শাহজাহান। ওই মামলার প্রধান আসামি হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা জুনাইদ বাবুনগরীকে ৬ মে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২৯ মে জামিন পান তিনি। সেই থেকে এখনও জামিনেই আছেন বাবুনগরী। একই মামলায় পরে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
দেশের সাত জেলার ৮৩ মামলায় বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অন্তত ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা সবাই জামিনে মুক্তি পান।
৫ মের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোতে হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, শীর্ষ নেতা মাওলানা মাইনুদ্দীন রুহী, শামসুল আলম, মহিবুল্লাহ বাবু, মাওলানা ফরিদ উল্লাহ, মুফতি ফয়জুল্লাহ, তাজুল ইসলাম, আবুল মালেক হালিম, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ফজলুল হক জিহাদি, মুফতি হারুন ইজাহার, মাওলানা ইলিয়াস ওসমানী, নূর হোসেন কাসেমী, মাওলানা মাহফুজুল হক, আবদুল কুদ্দুস, নুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত আমিনী, মুফতি নুরুল আমিন, শাখাওয়াত হোসেন, আতাউল্লাহ আমিন, রফিকুল ইসলাম মাদানীসহ হেফাজতে ইসলামের অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে আসামি করা হয়।
ঢাকার ৫৩টি মামলাতেই হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী প্রধান আসামি। এ ছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী এবং যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নেতা-কর্মীদেরও আসামি করা হয় সেসব মামলায়।