হঠাৎ আলোচিত হয়ে ওঠা নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি চিঠিও তৈরি করা হয়েছে। তবে সেটি তার কাছে কবে পাঠানো হবে, সেটি এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই এই কাদের মির্জা গত ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফা পৌর নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ঝড় তোলেন।
ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের ভাই, তিনিই আবার রাজপথে সক্রিয় সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে, বৃহত্তর নোয়াখালী এলাকায় দলের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে তোলেন সন্ত্রাস-দুর্নীতির অভিযোগ, এমনও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ওই এলাকায় তিন-চারজন ছাড়া আওয়ামী লীগের এমপিরা ঘর থেকেই বের হতে পারবেন না।
স্বভাবতই বিএনপি লুফে নেয় বক্তব্যটি। তারাও একই সুর তুলে নানান বক্তব্য দিতে থাকে।
কাদের মির্জার পৌরসভায় ১৬ জানুয়ারির ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা। বড় ব্যবধানে জেতেন নৌকা মার্কার প্রার্থী।
ভোটের পরও তার কথার লড়াই চালু থাকে। আর তখন লড়াইটি গিয়ে ঠেকে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে।
এ নিয়ে বাদানুবাদ একপর্যায়ে গিয়ে ঠেকে সংঘর্ষে। দলের দুই পক্ষের মারামারিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এক সাংবাদিক। এরপর কাদের মির্জা দৃশ্যত শান্ত হয়েছেন কিছুটা।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরে তিনি মারা যান। ছবি: নিউজবাংলা
কিন্তু পুরো ঘটনায় দলের কেন্দ্র বেশ বিরক্ত হয়েছে। আর এ জন্যই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর দুইজন সদস্য। তবে তারা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
একজন নেতা বলেন, ‘ওনাকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি, সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। চিঠিও রেডি আছে। যেকোনো সময় দিয়ে দেয়া হতে পারে।’
সভাপতিমণ্ডলীর অন্য যে নেতার সঙ্গে নিউজবাংলার কথা হয়েছে, তিনি জানান, চিঠিটি পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তুতিও তারা নিচ্ছিলেন। তবে পরে তাদের আরও কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এ কারণেই সেটি আর পাঠানো হয়নি।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন কাদের মির্জা নিজেও। বহিষ্কারের চিঠি প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন হবে তখন দেখা যাবে।’
এখন এলাকার পরিস্থিতি কেমন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার চারপাশে অস্ত্র তাক করে রাখছে। ভালো থাকি কীভাবে?’
কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি।
২০ ফেব্রুয়ারি কাদের মির্জাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে কেন্দ্রকে চিঠি দেয় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ।
তবে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আলম সেলিম মত পাল্টান।
এর কারণ জানতে চাইলে সেদিন তিনি বলেন, ‘বোঝেন না? একটা বিষয় আছে না? উপরের নির্দেশ আছে এ নিয়ে।’
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী জানান, কাদের মির্জাকে দল থেকে বহিষ্কারে তাদের সুপারিশ বহাল আছে।
সেই রাতেই ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলেন, ‘সেলিম ভাই ঢাকা থেকে এসে বলল মির্জার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সে হিসেবে আমরা মির্জার বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিয়েছি। এখন ইয়েতে বলতেছে এটা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আপনাদের বলতে পারি আমার জানামতে, আমি জানি না, কারণ একটা লোক অপরাধী যে নোয়াখালীতে না, সারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে ছোট করেছে। তাকে তো ছাড়া যায় না। তার বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিয়েছি জেলা আওয়ামী লীগ। আমার সভাপতি কী অবস্থানে আছেন জানি না, উনি নাকি বলতেছেন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
‘তার অবস্থান, তিনি আমাকে দিয়ে নির্দেশনা দিলেন, পরে উনি অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ালেন। উনিও নীতিগতভাবে নীতিহীন হয়ে গেলেন। আমি আপনাদের বলি, কাদের মির্জার অব্যাহতি অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন জায়গায় যেসব কথাবার্তা হচ্ছে এগুলো ঠিক না। কারণ এ ধরনের লোককে দলের অবস্থানে রাখা উচিত না। তার অব্যাহতিটা বহাল রইল।’
যেভাবে আলোচনায় কাদের মির্জা
পৌর নির্বাচন সামনে রেখে জানুয়ারির শুরুতে সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে মাঠে নামেন কাদের মির্জা। নিজের দলের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে আনেন দুর্নীতি, সন্ত্রাস লালনের অভিযোগ।
ছোট ভাইয়ের একের পর এক বক্তব্যে বিব্রত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি ভাইকে ফোন করে এমনও বলেছেন, ‘তুই আমার পদটা খাবি।’
আর এই কথাটাও জনসভায় ফাঁস করে দেন মির্জা।
তবে বসুরহাট নির্বাচনে জিতে নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছেন তৃণমূলের এই নেতা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছেন ফল। আর ফলের হিসাব বলছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর ভোটের যোগফলের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ বেশি পেয়েছেন কাদের মির্জা।
নির্বাচনের জিতেও থামানো গেল না মির্জাকে। স্পষ্ট করেছেন তার লড়াই নোয়াখালী সদর আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেই। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-ঘুষ আদায়ের অভিযোগ আনেন মির্জা।
এর মধ্যে একরাম ফেসবুকে এসে কাদের মির্জাকে ‘রাজাকার পরিবারের সন্তান’ বলে ‘আগুনে ঘি’ ঢেলেছেন। আর কাদের মির্জা এবার মাঠে নেমেছেন একরামকে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণের দাবি নিয়ে।
এই দাবিতে তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় হরতালেরও ডাক দিয়েছিলেন। তবে ওবায়দুল কাদেরের অনুরোধে তা স্থগিত করেছেন।
৩০ জানুয়ারি ঢাকায় এসে ভাই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন মির্জা। সাক্ষাৎ শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন কাদের মির্জা। তিনি বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে নোয়াখালীর অপরাজনীতির বিষয়ে অভিযোগ আছে। সেগুলো উনি যাচাইবাছাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
‘এখন যেটা হবে, যদি এটা সমাধান না হয় নোয়াখালীর অপরাজনীতি বন্ধ না হয়... টেন্ডারবাজি, চাকরি বাণিজ্য, প্রশাসনের উপর প্রভাব খাটিয়ে যে অপরাজনীতি চলছে, এটা যদি বন্ধ না হয়, যদি অস্ত্রবাজি বন্ধ না হয় তাহলে এক মাস পর, তাহলে আমরা আবার প্রেস ক্লাবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী কর্মসূচি নেব।’
১৬ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর পুলিশ সুপার, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি ও পরিদর্শক তদন্তকে প্রত্যাহার এবং উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ফখরুল ইসলাম সবুজকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রাত ৯টায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন মির্জা।
নোয়াখালীর এসপি, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসির প্রত্যাহার দাবিতে সম্প্রতি থানার সামনে অবস্থান নেন কাদের মির্জা ও তার সমর্থকরা। ছবি: নিউজবাংলা
ওই দিন রাতে শুরু করে পরদিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার ফটকের সামনে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে এই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তিনি।
দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছেও নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন মির্জা। ১৬ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন। তিনি দাবি করেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই কাদের মির্জা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি বসুরহাটে মির্জার উপস্থিতিতে তার অনুসারীদের সঙ্গে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। চারজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন ৪০ জন। এ ঘটনায় পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেন কাদের মির্জা।
হরতালের সমর্থনে মিছিল চলাকালে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। বসুরহাট বাজারের রূপালী চত্বর থেকে জমায়েত হয়ে মিছিল নিয়ে থানার সামনে গেলে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে।
মির্জা কাদেরের সমর্থকরা দাবি করেন, সকালের দিকে পুলিশ মারমুখী আচরণ করে। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে তাদের ১২ জন নেতা-কর্মী আহত হন। আর কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারির সেই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির পরদিন মারা যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এরপর কাদের মির্জা শান্ত হন। তিনি আর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি নিয়ে আসেননি।