নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের পাশাপাশি সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনের জন্য নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন ছয় সিটি করপোরেশনে বিএনপির পরাজিত মেয়র প্রার্থীরা।
মাসজুড়ে ঘোষিত ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার বরিশাল জিলা স্কুল মাঠের সমাবেশে এই বক্তব্য দেয়া হয়।
মহানগরগুলোতে বিএনপির সমাবেশের প্রথমটি হওয়ার কথা ছিল গত ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে। তবে সেদিন বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ করায় সেটি হয়নি।
বরিশালের সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি শুরু হলো।
এই সমাবেশে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, খুলনা সিটি করপোরেশন ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থীরা বক্তব্য রাখেন।
এদের মধ্যে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দুই নগর, গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম এবং ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই বাকি তিন মহানগরে ভোট হয়।
আড়াই বছর আগের সেই ভোটে গাজীপুরেও হেরেছিল বিএনপি। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না সেখানে।
এই সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সড়ক পথে রওনা দেন। কিন্তু তাদের যাওয়ার পথে বিঘ্ন ঘটানো হয়। ফেরি পারাপার বন্ধ রাখা হয় কয়েক ঘণ্টা। পরে লঞ্চে করে নদী পার হয়ে নেতা-কর্মীরা গাড়ি ভাড়া করে বরিশালে যান।
জিলা স্কুলমাঠে এই সমাবেশ ঘিরে বরিশাল নগরে নেয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। মোড়ে মোড়ে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি করা হয় নেতা-কর্মীদের। সমাবেশস্থলে রাখা হয় সাঁজোয়া গাড়ি ও জলকামান।
অবশ্য সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের কোনো গোলযোগ হয়নি। তবে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
সমাবেশে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি হয়
ঢাকা সিটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির হয়ে পরাজিত প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আছি। আমাদের কোনো বাধায় আটকাতে পারবে না।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ১৩ বছর ধরে অত্যাচার, নির্যাতন, মামলা-হামলার শিকার হয়ে যেভাবে মাঠে আছেন, আপনাদের দেখে আমি আরও উজ্জীবিত হলাম৷ ইনশাল্লাহ বরিশাল থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন পাকাপোক্ত হবে৷’
ইশরাক বলেন, ‘জনগণের ভোটে আসার সুযোগ নেই বলেই বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানাই এবং নির্দলীয় নিরপক্ষে সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর উচ্চ আদালত এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এরপর সরকার সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে।
সমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ
এই সিদ্ধান্ত না মেনে বিএনপি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সহিংস আন্দোলন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনও করে তারা। এরপর ২০১৫ সালে সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ঘরে ফেরে। এরপর বিএনপি আর কোনো বড় কর্মসূচিতে যায়নি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যায় বিএনপি। গঠন করে নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সঙ্গে ছিল বিএনপির আগের জোট ২০ দল। তবে ভোটে সুবিধা করতে পারেনি তারা। ইতিহাসের সর্বনিম্ন আসন পেয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও হারিয়েছে তারা।
বিএনপি অবশ্য এই নির্বাচনের ব্যাপক সমালোচনা করছে। তাদের দাবি, আগের রাতে ভোট দিয়ে এবং ভোটের দিন ভোটারদের কেন্দ্র থেকে দূরে রেখে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে।
এই ভোটের ফলাফল না মেনে সংসদে না যাওয়ার ঘোষণাও ছিল বিএনপির। পরে অবশ্য সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি তারা।
ওই নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনেও বিএনপি পাত্তা পাচ্ছে না। আর ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না অভিযোগ করেই এই সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে।
মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘তারেক রহমানের নির্দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশ শুরু করেছি আমরা। মাফিয়া সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তাই শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
ঢাকা সিটি উত্তর করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘জালিম সরকার স্বাভাবিক নির্বাচন হতে দিচ্ছে না। কোনো নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারছে না। সরকার বলে তারা দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে না। কিন্তু তারা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সিটি নির্বাচনগুলোতে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার স্বপ্ন দেখছে সরকার। আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারেরর অধীনে নির্বাচন চাই, মাফিয়া সরকারের অধীনে নয়।’
গোলযোগের আশঙ্কায় সকাল থেকেই সমাবেশ স্থল ও আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ। তবে তাদের সঙ্গে কোনো হাঙ্গামা হয়নি
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ চাই এবং নির্বাচনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন চাই।’
তবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন প্রধান অতিথি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘পাশের দেশ মিয়ানমারে সামরিক শাসন হয়েছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। বর্তমান সরকারের শাসন তো সেই স্বৈরশাসকের চেয়েও খারাপ। আমরা কয়জন রাজপথে নামতে পেরেছি?
‘আজকের এই সমাবেশে আসার সময় জায়গায় জায়গায় পুলিশ আমাদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করেছে, আটক করেছে, বাধা দিয়েছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে সেই প্রতিবাদ কোথায়? সেই প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
বিএনপি নেতা বলেন, ‘এখনকার তরুণরা কী অবদান রাখছেন এই দেশের জন্য? এখনই সময় এই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে নামার। আসুন, আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে হটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করি।’
কেন্দ্রীয় বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ‘সমাবেশস্থলে আসতে আজ পথে পথে বাধা দেয়া হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। ভোলার নেতা-কর্মীদের আসতে দেয়া হয়নি। সমাবেশস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ। তারপরও নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রাখা যায়নি।’