দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের দণ্ড স্থগিত। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অবস্থান করছেন তার বাসভবন ফিরোজাতেই।
কিন্তু দলের কোনো কর্মকাণ্ডেই নেই ৩৭ বছরের চেয়ারপারসন। গত প্রায় চার দশকে এমনটি কখনও দেখা যায়নি।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফেরার পর কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য আসেনি বিএনপি নেত্রীর পক্ষ থেকে। এমনকি স্বাধীনতা দিবস, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলোতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েও কোনো বিবৃতিও দেননি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পর কারাগারে গিয়েও খালেদা জিয়া দলের নানা সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছেন। নেতাদের বিভিন্ন কাজে নিষেধ করেছেন। কিন্তু এবার কাউকে তিনি ডাকছেনও না।
আবার চেয়ারপারসন কারামুক্ত, কিন্তু তিন বছর ধরেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানকে রেখে দিয়েছে বিএনপি।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফেরেন খালেদা জিয়া। ছবি: এএফপি
কী কারণ?
বিএনপির একাধিক নেতা নিউজবাংলাকে বলেছেন, দণ্ড স্থগিত করে কারামুক্ত হলেও তারা দলের নেত্রীকে বন্দিই ভাবছেন।
একজন নেতা বলেছেন, সাময়িক মুক্তির জন্য যে দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে, তার পাশাপাশি অন্য শর্তও আছে। তবে সেই শর্ত কী, সেটি বলেননি তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে নেয়ার পর বিএনপি আইনি লড়াই ও রাজপথে কর্মসূচি দিয়ে নেত্রীকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে আপিল করে দণ্ড হয়েছে দ্বিগুণ। পাঁচ বছরের বদলে ১০ বছর কারাগারে থাকার আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
আবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড হয়েছে সাত বছরের।
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আপিল বিভাগে ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টে আবেদন করলেও শুনানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বিএনপি নেত্রীর আইনজীবীরা।
এর মধ্যে তার কারাবন্দিত্বের তিন বছর পূর্তি হয়ে গেল। দিনটিতে বিএনপি জোরাল কোনো কর্মসূচিও না দিয়ে জেলায় জেলায় সমাবেশের ডাক দিয়েছে। আগের দুই বছরেও একই ধরনের কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল, যেগুলো পালিত হয়েছে নামকাওয়াস্তে।
এবার আবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে নেই। চিকিৎসার কথা বলে তিনি সম্প্রতি গেছেন সিঙ্গাপুরে। পরে গেছেন দলের আরেক নেতা মওদুদ আহমদ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন তার নেত্রী কারাগারের বাইরে এলেও পুরোপুরি মুক্ত নন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। ফাইল ছবি
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তিনি এখনও একরকম বন্দিই আছেন। সেই অবস্থায় তিনি কীভাবে দলের দায়িত্ব নেবেন?’
গত বছরের মার্চে খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় দুটি শর্তের কথা। এক. বিএনপি নেত্রী দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। দুই. তিনি চিকিৎসা নেবেন ঘরে বসেই।
গয়েশ্বর বলেন, ‘আপনারা কেউই ম্যাডামের মুক্তির পেছনের সকল শর্তকে সামনে আনতে পারেননি। যে যে শর্ত সামনে আসছে, তার বাইরেও হিডেন (গোপন) শর্ত রয়েছে।’
কী সেই শর্ত?
বিএনপি নেতা বলেন, ‘আপনারা সেটা খুঁজে বের করেন। আমি কিছু বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই, এই যে বলা হয়েছে তিনি চিকিৎসা পর্যন্ত ঘরে বসে করবেন। এর মানে কী দাঁড়ায়?’
খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে দাঁড়ানো সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) এখনও মুক্ত নন। তিনি একরকম বন্দিদশাতেই আছেন।’
তাহলে খালেদা জিয়াকে কি আর রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাবে না?
ব্যারিস্টার জমির বলেন, ‘আপনার সুযোগ থাকলে কি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবেন? তাহলে সুযোগ থাকলেও একজন রাজনীতিবিদ কেন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবে? নিজেকে এই প্রশ্ন করলেই তো সব উত্তর পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘শুধু যে বন্দিটা তো নয়। উনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ। তাকে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় এমন অবস্থায় নিয়ে গেছেন যে এখন ঠিকভাবে হাঁটতেও পারেন না। এটাকে আপনারা কী বলবেন?’
তারেক কেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
খালেদা জিয়া প্রথম যে মামলায় সাজা পেয়েছেন, সেটাতে ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় তারেক রহমানেরও। তিনি আরও তিনটি মামলায় দণ্ডিত। যার একটিতে হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, একটিতে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা এবং একটিতে হয়েছে দুই বছরের কারাদণ্ড।
তবু তারেককে বিএনপি নেতৃত্বে রেখেছে এ কারণে যে, তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
পাঁচ বছর আগে বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য সফরে গেলে দেখা হয় তারেক রহমানের। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু খালেদা জিয়া প্রায় এক বছর আগে কারাগার থেকে বাইরে আসার পরও তার ছেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ রয়েই গেছেন।
এর কারণ কী?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ম্যাডামের অনুপস্থতিতে তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দলকে সক্রিয় রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে তা গঠনতন্ত্রের বাইরে নয়।’
বিএনপির কর্মসূচি
দলের চেয়ারপারসনকে প্রথম সাজা দেয়ার তিন বছরের দিনটিতে দেশের সব মহানগর ও জেলা শহরে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সকাল ১০টায় হবে এই সমাবেশ। উপস্থিত থাকবেন দলের শীর্ষ নেতারা।
বিএনপিমনা সংগঠন নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম পরদিন রাজধানীতে মোমবাতি প্রজ্বালনের কর্মসূচি দিয়েছে।
নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে এই কর্মসূচি পালিত হবে মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে চারটায়। দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী এতে প্রধান অতিথি থাকবেন।
এই কর্মসূচিটি বিএনপির জন্য অভিনব। এর আগে কখনও এই ধরনের কর্মসূচি তারা দেয়নি।
কারাবাসের বর্ষপূর্তির দিন আদালতে থাকার নির্দেশ
যে দুই মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাজা হয়েছে, এর বাইরে আরও অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কারাগারে যাওয়ার দিনটিতে নাইকো দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ এসেছে।
যদিও হাজির থাকার নির্দেশ এর আগেও নানা সময় উপেক্ষা করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এবারও তিনি যাবেন কি না, সেটা নিশ্চিত নয়।
বিএনপি নেত্রীর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার শনিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবারও সময়ের আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আরও একটি আবেদন জমা দেয়ার হয়েছে।’
তাহলে নির্দেশনা অনুযায়ী খালেদা জিয়া আদালত হাজির হচ্ছেন না?
এমন প্রশ্নে মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘এখনো আসলে ঠিক বলা যাচ্ছে না।’