ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিদ্রোহের মুখে কেন্দ্রীয় কমিটির ৩২টি পদ শূন্য ঘোষণা করা হয় ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এরপরও বিতর্ক ও নানা কারণে ফাঁকা হয় আরও কিছু পদ।
এক বছরের বেশি সময় পর রোববার পূরণ করা হয় ৬৮ শূন্য পদ। তবে অভিযোগ আছে, এসব পদে ফের স্থান পেয়েছেন বিতর্কিতরা। নিষ্ক্রিয়, বেশি বয়স, ছাত্রদলের সাবেক কর্মী, সহিংসতা ও অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
বিতর্কিতদের একজন আমানুল্লাহ আমান, তিনি গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক হয়েছেন।
অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে দেখা না গেলেও ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল চালক হওয়ার সুবাদে তাকে গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক করা হয়েছে।
আল নাহিয়ান খান জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। একই হলে থাকেন আমানুল্লাহ আমান, যিনি প্রতিদিন জয়কে নিজ বাইকে মধুর ক্যান্টিন, টিএসসিসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান।
এর আগে তিনি সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর মোটরসাইকেল চালকও ছিলেন বলে জানা গেছে। রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর জয়ের অনুসারী হন।
সংগঠনের একাধিক নেতার অভিযোগ, আমানুল্লাহ আমানকে ছাত্রলীগের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া, এর আগে তিনি কখনো ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না।
ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনিকে করা হয়েছে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক। রনির এসএসসির মার্কশিট অনুযায়ী, তার জন্ম তারিখ ১৯৮৭ সালের ২২ জুন। সে হিসাবে তার বয়স হয়েছে ৩৩ বছর ৭ মাস ১১ দিন৷
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর ক উপধারায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব ২৮ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন।
দেবাশীষ সিদ্ধার্থ হয়েছেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকির সই জাল করে ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুই ছাত্রকে ভর্তি করাতে গিয়ে ধরা পড়েন এই নেতা। পরে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময় তিনি ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের ছাত্র ও স্কুলবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন, তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলাও রয়েছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শুভ্রদেব হালদার। ছবি: নিউজবাংলা
নতুন সহসভাপতি শুভ্রদেব হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও গুরুতর। তাকে নিয়ে অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকে ডাকাতি ও ছিনতাই করা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হোতা তিনি।
এ নিয়ে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রতিবেদনও করেছে। যেখানে পিবিআইও বলেছে, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক থাকা অবস্থায় শুভ্রদেব ওই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করতেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী মেহেদী হাসান ও আশিক পারভেজকে গ্রেপ্তার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে স্বাধীন ও আলমগীর খাঁ নামের আরও দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদের মধ্যে মেহেদী হাসান ছাড়া বাকি তিন জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিন জনই তাদের জবানবন্দিতে র্যাবের পোশাকে টাকা লুটের একটি ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে শুভ্রদেবের কথা উল্লেখ করেন।
আরেক সহসভাপতি জিয়াসমিন শান্তাকে নিয়েও আছে বিতর্ক। এর আগে তিনি শামসুন নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেত্রী ফাল্গুনী দাস তন্বীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হলে সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারধর, ক্যান্টিন ও হলের সামনের দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
উপপ্রচার সম্পাদক হয়েছেন ফেরদৌস মাহমুদ পলাশ৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে, তার দেওয়া ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছে৷
অভিযোগ নিয়ে যা বলেছেন নতুন পদ পাওয়া নেতারা
অভিযোগের বিষয়ে আমানুল্লাহ আমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই অদ্ভুত, ছাত্রলীগের প্রত্যেকটা প্রোগ্রামে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং প্রতিটি প্রোগ্রামের পেছনের কাজগুলো আমিই করেছি।’
কোনো পদে না থেকেও বিভিন্ন কর্মসূচির পেছনে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্মী হিসেবে আমি তো এসব কাজ করতেই পারি।’
ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করছি। সংগঠনের বিরুদ্ধে কখনো বিদ্রোহ করিনি। হয়তো এ কারণে আমাকে পদোন্নতি দিয়ে মূল্যায়ন করেছে।’
বেশি বয়সের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে, দেবাশীষ সিদ্ধার্থ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ রকম একটি মামলা করেছিল। তবে সে মামলায় আমি জয়যুক্ত হয়েছি।
‘তারা এ রকম কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মহামান্য আদালত আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। সেটির প্রমাণ আমার কাছে আছে।’
প্রমাণ দেখতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার কাছে ডকুমেন্টটা নেই। আমি পরে আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকে ছিনতাইয়ের অভিযোগ বিষয়ে শুভ্রদেব হালদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কে বা কারা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি আমার নামে করেছে।
‘আমি ঢাকা কলেজে ১১ বছর রাজনীতি করেছি। এই সময়ে আমার সঙ্গে অনেক ছোট ভাই রাজনীতি করেছে। তাদের কেউ যদি অপরাধ করে, সে দায় আমার না।’
অপরাধীদের জবানবন্দির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিছে, তাদের আমি চিনিও না। আর তারাও মনে হয় না আমাকে দেখলে চিনবে। এই জবানবন্দি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
উপপ্রচার সম্পাদক পলাশ আগে ছাত্রদল করার অভিযোগ নাকচ করেছেন। তিনি দাবি করেন, তার নামে ভুয়া ফেসবুক পেজ খুলে সেখানকার বিভিন্ন স্ক্রিনশট ছড়ানো হচ্ছে।
আর জিয়াসমিন শান্তাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি দেওয়া হয় ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। এরপর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য।
তিন মাস ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের পূর্ণাঙ্গ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির ২১ জনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে এসব পদ শূন্য ঘোষণা করেন জয়-লেখক। এ ছাড়া ১১ জন স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন।
এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে পূরণ করা শূন্যপদে বিতর্কিতরা ফের কীভাবে স্থান পেলেন, জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেবাশীষ সিদ্ধার্থ মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। আর ইন্দ্রনীল দেব শর্মা আগে থেকেই কমিটির সদস্য ছিলেন। সদস্য থেকে তাকে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।’