বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভেঙে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট

  •    
  • ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২১:৫৩

‘আমরা ভোটের সঙ্গী হিসেবে তাদেরকে (জামায়াত) সঙ্গে নিয়েছিলাম। পর্যালোচনা করে দেখা গেল, তাদের দিয়ে উল্টো বিএনপি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের প্রতি জনগণের যে নেতিবাচক ভাবনা আছে, সেটার দায়ভারও আল্টিমেটলি বিএনপিকে নিতে হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে সামনে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটেও আর থাকবে না বিএনপি।’

২২ বছর জোটবদ্ধ থাকার পর বিএনপি ও জামায়াতের বন্ধন আলগা হতে চলেছে।

বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কিনারায় তারা। যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।

বিএনপির এক নেতা বলেছেন, তারা জামায়াতকে তালাক দেবেন। আর এই সিদ্ধান্ত কেন, তার কারণ উল্লেখ করে চিঠিও প্রস্তুত হচ্ছে।

জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হলেও জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া বা না যাওয়ার বিষয়ে বিএনপিতে কোনো আলোচনা নেই। দলটি মনে করে, বাকি দলগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় জামায়াত ও বিএনপি। সঙ্গে ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং আজিজুল হকের ইসলামী ঐক্যজোট।

প্রথমে এরশাদ ও পরে আজিজুল হক জোট ছেড়ে দেন। তবে সমালোচনার মধ্যেও জামায়াতকে বিএনপি কখনো ছাড়তে রাজি হয়নি।

তবে বিএনপি চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ করে পরে ২০-দলীয় জোট গড়েছে। পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরও একটি জোট তারা করে গত সংসদ নির্বাচনের আগে।

এর মধ্যে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ নানা সময়ই এসেছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, সময় এলে তারা জামায়াতকে ছেড়ে দেবেন।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে যে চারদলীয় জোট গঠন করে তাতে যোগ দেন জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। পরে তিনি জোট ছেড়ে গেলে তার দলে ভাঙন ধরে এবং একাংশ এই জোটে থেকে যায়।

তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধভাবেই করে। কিন্তু এরপর নানা ঘটনায় দুই পক্ষে দূরত্বও দেখা যায়।

সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনের তিন ধাপ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পাশে ছিল না জামায়াত।

এর আগে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন না দিয়ে জামায়াত আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল।

এ নিয়ে বিএনপি অবশ্য কিছু বলেনি তাদের জোটসঙ্গীকে। দলের একাধিক নেতা বলেছেন, পৌর নির্বাচনসহ সব পর্যায়ে তারা একাই নির্বাচন করতে চান।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে। শিগগিরই জামায়াতকে তা লিখিত আকারে জানানো হবে। সেখানে ব্যাখাও দেওয়া হবে, কী কী কারণে জোট ভাঙা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বারবার স্থায়ী কমিটি থেকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের প্রস্তাব করা হচ্ছিল। সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছিল।… জামায়াতকে নিয়ে আমরা আর এগোচ্ছি না। তারা তো শুধু ব্যবসা বোঝে, মুনাফা খোঁজে।’

সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এক সভায় জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে লাভ-লোকসান নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। সেখানে বিএনপির তিন নেতা খন্দকার মোশারফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বারবার জামায়াতের সঙ্গে জোট ত্যাগের পরামর্শ দেন। পরে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরেই বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যায়।

এ বিষয়ে জানতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে ফোন করা হলে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তিনি কেবল বলেন, ‘জোট রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত দলের। ব্যক্তিগতভাবে আমার না। দল সিদ্ধান্ত নেবে কী হবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী জোট রয়েছে। সেটিকে রাখা না রাখার বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদি কখনো হয়, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন আমরা দলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। সেটা নিয়েই ভাবছি।’

জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির লাভ হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় অনেক ছোট কথা থেকেও অনেক কিছু হয়ে যায়। আমি দলে না থাকলে হয়তো বলতে পারতাম না। সেটা সম্ভব না। তার ওপর আমি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য।’

জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধী নেতা প্রয়াত গোলাম আযমের সঙ্গে এক ইফতার মাহফিলে বেগম খালেদা জিয়া

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের আলোচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই। জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমানের লেখা একটি বইয়ে উল্লেখ আছে, তারা সে সময় ১০০টি আসন চেয়েছিলেন বিএনপির কাছে। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ায় জোট আর হয়নি। পরে অঘোষিতভাবে ৩৫টি আসনে জামায়াতকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিনিময়ে তারাও দেশের বাকি আসনগুলোতে বিএনপির হয়ে কাজ করেছেন।

১৯৯৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত পুরোপুরি আলাদা নির্বাচন করে। তখন ভরাডুবি হয় জামায়াতের। তারা জেতে মাত্র তিনটি আসনে। এরপর বিএনপি ও জামায়াত দুই পক্ষই একে অপরের গুরুত্ব বুঝতে পারে।

১৯৯৯ সালে জোট করার দুই বছর পর যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে এই জোটের ভূমিধস জয়ের পেছনে দুই দলের ভোট যোগ হওয়াই ছিল প্রধান কারণ।

তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার জামায়াত সঙ্গ বিএনপির জন্য নেতিবাচক হিসেবেই ধরা দেয়। ওই নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বড় হয়ে ওঠার পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ভরাডুবি হয়। স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে সঙ্গী করে ভোটে নেমে দীর্ঘদিনের শক্তিশালী অবস্থানেও বড় ব্যবধানে হেরে যায় বিএনপি।

ওই নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে ১০টি কমিটি গঠন করা হয় বিপর্যয়ের কারণ পর্যালোচনার জন্য। এর মধ্যে ৯টি কমিটিই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতাকে দায়ী করে, যা ছিল বিএনপির তৃণমূল নেতাদের অভিমত।

নির্বাচনের পর বিএনপির তরুণ নেতারাও প্রকাশ্যেই দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দাবি তোলেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

তবে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে এবং নির্বাচনের পর সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াতকে নিয়েই যোগ দেয় বিএনপি। আর ব্যাপক সহিংসতার পর বিএনপি নেতারা নানাভাবে জামায়াতকে দায় দেন।

ওই নির্বাচনের পর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট কৌশলগত। সময় এলেই তিনি জামায়াতকে ত্যাগ করবেন।

এসব ঘটনায় আবার জামায়াত মনঃক্ষুণ্ন হয় বিএনপির প্রতি। যদিও তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য আসেনি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়ে তোলার পরও জামায়াতের সঙ্গে জোট আর থাকবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা হয়ে ওঠা ড. কামাল হোসেন প্রকাশ্যেই বলেন, জামায়াত আছে জানলে তারা জোটেই যেতেন না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বলেন, ‘আমরা ভোটের সঙ্গী হিসেবে তাদের (জামায়াত) সঙ্গে নিয়েছিলাম। পর্যালোচনা করে দেখা গেল, তাদের দিয়ে উল্টো বিএনপি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের প্রতি জনগণের যে নেতিবাচক ভাবনা আছে, সেটার দায়ভারও আল্টিমেটলি বিএনপিকে নিতে হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, সামনে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটেও আর থাকবে না বিএনপি।’

তিনি বলেন, “আমি এটাকে বলব ‘আপাতত তালাক’। মানে যত দিন না আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জোট থেকে বাদ দেওয়ার কথা জানানো হবে, তত দিন এই আপাতত তালাক হয়েই থাকবে। তাদের নিয়ে রাজনীতির মাঠে আর থাকারই প্রশ্ন আসে না।”

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আরেক নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই অবস্থায় সাংগঠনিক অবস্থাও ভেঙে পড়েছে জামায়াতের।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়ে তোলে, যার প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন ড. কামাল হোসেন। তবে এই জোট এখন নিষ্ক্রিয়

দলের নেতাদের এই বিচারের সময় বিএনপির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতাও পায়নি জামায়াত। এ নিয়েও খেদ আছে দলের নেতাদের মধ্যে।

আবার রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার যোগ্যতাও হারিয়েছে জামায়াত।

বিএনপির সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা এ বিষয়ে জানিই না।’

‘পত্রিকার কাটতি করার জন্য এমন যে খবর বের করে এগুলো সে ধরনের কথা’- এমন মন্তব্য করে জামায়াত নেতা বলেন, ‘আমরা জোটে আছি। আর জোটের মধ্যে কোনো প্রশ্ন উঠলে জোটে তার আলোচনা হবে।’

পরওয়ার বলেন, ‘আমরা মনে করি, জোটের প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিএনপির সঙ্গে জোট ভাঙার আলোচনা কখনো ওঠেনি।’

বিএনপির সঙ্গে কোনো শীতলতা নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা সেদিনও মিটিং করেছি। যোগাযোগ হচ্ছে। সম্পর্ক আগের মতোই আছে।’

বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কর্মপরিষদের সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা নির্বাচনে যাইনি, তাই আমরা সমর্থনও দিইনি।’

জুবায়ের এ কথা বললেও নোয়াখালীর বসুরহাট, বরগুনার পাথরঘাটা, রাজশাহীর কাটাখালী, দিনাজপুরের বীরগঞ্জসহ বিভিন্ন পৌরসভায় জামায়াতের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেছেন। আবার রংপুরের বদরগঞ্জে বিএনপি জামায়াত নেতাদের সমর্থন চেয়েও পায়নি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াত নেতা জুবায়ের বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা কারও পক্ষেও নাই, বিপক্ষেও নাই। নির্বাচন বিএনপি করেছে। তারা করবে কী করবে না এটা তাদের বিষয়।’

এ বিভাগের আরো খবর