পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত সিপিবির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনজুরুল আহসান খান সরকারের প্রশংসা সূচক কিছু বক্তব্য দেয়ায় নিজ দলে এখন কোণঠাসা।
সিপিবিতে দলীয় পদ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে কার্যত তাকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তবে এমন পদক্ষেপে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে দলের ভিতরেই।
প্রবীণ রাজনীতিক মনজুরুল আহসান খানের বিষয়ে সিপিবির সিদ্ধান্ত দলের একটি অংশ ভালো চোখে দেখছে না, যদিও এ নিয়ে প্রকাশ্যে তারা কিছু বলছে না।
মনজুরুল বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কাজ চলছে। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
মনজুরুলের এমন মূল্যায়ন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেছে বলে সাংগঠনিকভাবে মনে করছে সিপিবি। এ কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
মনজুরুল এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার কথা জানিয়েছেন, তবে শেখ হাসিনা সরকারেরর ভালো দিকের প্রশংসা করার আগের অবস্থানেই তিনি অনড়। একইসঙ্গে তার দলের অনেকে সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে যে মূল্যায়ন করে, তা ভুল-এটাও বলেছেন নিউজবাংলাকে।
এর আগেও সিপিবির পক্ষ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের জন্য একটি নির্দেশনা জারি করা হয় যাতে বলা হয়, ফেসবুক বা অন্য কোথাও দলের সমালোচনা করা যাবে না।
আরও পড়ুন: অবশ্যই হাসিনার সাফল্য আছে
নিউজবাংলার অনুসন্ধান বলছে, মনজুরুলকে ঘিরে সিপিবিতে দুটি ভাগ হয়েছে। অনেকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সিদ্ধান্তকে মানতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে অনলাইনে সিপিবির হয়ে লেখালেখি করেন এমন একজন বলেন, ‘দুই পক্ষই ছেলেমি করছে।’
মনজুরুল সরকারের যে উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেছেন, নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে সিপিবির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স তার কয়েকটির কথা উল্লেখ করে একে ভালো কাজ বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু ভালো হয়েছে। এটা পার্টি থেকেই বলছি আমরা। এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, অবশ্যই পজিটিভ কাজ। তিনি (মনজুরুল) তো এ কথাই বলছেন, যেখানে কোনো দ্বিমত নেই। তিনি যা বলেছেন ভুল বলেননি।’
তাহলে মনজুরুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন?
প্রিন্স বলেন, ‘সেটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে দৃশ্যমান হবে। এটাই হচ্ছে সমস্যা। এই লেখাটার বিষয়ে আমাদের পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না।’
তিনি বলেন, ‘পরিষ্কার ভাষায় আমরা চার শত্রুর মোকাবিলা করছি। গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাটতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা আরেক শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। এইটা আমরা মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি। তার একটা প্রধান কাজ হচ্ছে আওয়ামী লীগ ধারা ও বিএনপি ধারার বিপক্ষে বিকল্প সমাবেশ গড়ে তোলা।’
দলে বিভেদের বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করছেন প্রিন্স। বলেন, ‘এখানে কোনো সংকট দেখি না। বরং পার্টি পজিশনই ক্লিয়ার। আমাদের পার্টির রাজনীতিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
সিপিবির নারী সেলের নেত্রী লুনা নূর বলেন, ‘এটা তো প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত। যখন কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হবে, তখন বিষয়টি স্পষ্ট হবে।’
এটা নিয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এককভাবে আমার বলার কিছু নেই। পার্টির সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। তবে পার্টির এরকম দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এ ধরনের কথা বলা মানে জনগণকে বিভ্রান্ত করা।’
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও সিপিবি কর্মী বাকী বিল্লাহ বলেন, ‘মনজুরুল আহসান খান বা পার্টির সিনিয়র নেতারা তারা পার্টির যে লাইনটা তৈরি করেছেন, এই লেখার মধ্য দিয়ে নিজেদের সেই লাইনটার সাথেই কন্ট্রাডিকটরি আচরণ হয়। এটা যে কেন করছেন এটার পেছনে যে রাজনীতি, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে।’
অন্যদিকে, সিপিবির সিদ্ধান্তের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিভেদের কোনো ঘটনা নেই। আমাদের প্রেসিডিয়াম তো আমরা একমত হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
পত্রিকার কলামে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের জন্য বর্ষীয়ান একজন নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কী বার্তা দেয়- এমন প্রশ্নে সিপিবি সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের একটা গঠনতন্ত্র আছে। গঠনতন্ত্রের ঊর্ধ্বে পার্টির কোন সদস্য না। সেই গঠনতন্ত্র মেনেই পার্টির সদস্যকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। না হলে পার্টির মধ্যে সংহতি থাকে না। নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।’
সরকারের কোনো কাজের প্রশংসা করলে তা গঠনতন্ত্র বিরোধী হয় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না। সাফল্য থাকলে প্রথমে ইনার পার্টিতে (পার্টির ভেতর) বলবেন, সাফল্য ব্যর্থতা যেই বলুক প্রথমে ইনার পার্টিতে বলবেন। সেখানে যদি সকলে মেনে নেয় তাহলে তিনি সেটা বাহিরে বলবেন।’
এটাই সিপিবির গণতান্ত্রিক রীতি জানিয়ে শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের পার্টি যৌথ নেতৃত্বে চলে। কোনো একক বিষয়ে প্রাধান্য দেয় না।
‘আমাদের পার্টি গণতান্ত্রিকভাবেই চলে। আমাদের লিডারশিপ নির্বাচিত হয় গোপন ভোটে। যা বাংলাদেশের অন্য কোনো পার্টিতে নাই।’