প্রায়শ সভা সমাবেশ বা ধর্মীয় আলোচনায় ৯০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে উত্তেজক বক্তব্য রাখা ধর্মীয় দলগুলো ভোটের মাঠে একেবারেই দুর্বল।
জাতীয় নির্বাচনগুলোতে জোটের প্রার্থী হিসেবে বড় দলের সমর্থনে কখনও কখনও জিতে আসলেও একক শক্তিতে জয়ের উদাহরণ নেই বললেই চলে। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও যে তারা ভালো করে এমন নয়।
গত ২৮ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ২৪টি পৌরসভা নির্বাচনে নয়টিতে প্রার্থী ছিল ইসলামী আন্দোলনের। এর মধ্যে বরিশালের একটি পৌরসভায় বহু ব্যবধানে দ্বিতীয় হলেও বাকি কোনোটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি কেউ।
আর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর প্রার্থী পাওয়া গেছে একটিতে। জামানত হারিয়েছেন তিনিও। বাকি দলগুলোর প্রার্থীই ছিল না।
আগামী ১৬ জানুয়ারি পৌর নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে যে ৬১ পৌরসভায় ভোট হচ্ছে, সেখানেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে কেবল ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে। তাও অর্ধেকের কম, ২৯টি পৌরসভায় আছে হাতপাখার প্রার্থী।
ভোটের মাঠে দুর্বল হলেও ইদানীং প্রায়ই ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে দেয়ার কথা বলছেন নেতারা। হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফতে মজলিসের নেতা মামুনুল হক সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে এমনও বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলবেন। কিন্তু তারা ভোটে ক্ষমতায় আসার মতো শক্তি অর্জন করতে পারবেন, এমন বিশ্বাস নেই খোদ দলটির নেতাদের মধ্যেই।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে নিজেদের দলীয় প্রতীকে ভোটের ময়দানে লড়ার অধিকার হারিয়েছে দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটি এখন দলীয় প্রতীকে ভোটের অধিকার হারিয়েছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায়।
নিবন্ধিত ১২টি দলের মধ্যে এই মুহূর্তে ভোটে ভালো করছে ইসলামী আন্দোলন, যদিও তারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উঠে আসার ক্ষেত্রে অনেক দূরে।
বাকি ১১টি দলের মধ্যে চারটি আছে আওয়ামী লীগের জোটে। পাঁচটি দল আছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটে, যদিও এক সময় তারা নারী নেতৃত্বকে হারাম বলত।
দুটি দল ২০ দল থেকে বেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে চারটি কোনো জোটে নেই।
ধর্মভিত্তিক সবচেয়ে প্রাচীন দুই দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাকিদের অবস্থাও একই রকম।
পৌর নির্বাচনে কেমন ভোট পড়ল?
গত ২৮ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে দলের নয় জন প্রার্থীর মধ্যে একজন সাড়ে চার হাজারের মতো ভোট পেয়েছেন। বাকিদের বাক্সে পড়েছে নগণ্য সংখ্যক ভোট।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পৌরসভার প্রার্থী হাফিজুর রহমান পেয়েছেন ১৪৩ ভোট। রংপুরের বদরগঞ্জ সাদ্দাম হোসেন পেয়েছেন ৩২৭ ভোট, কুড়িগ্রামে আব্দুল মজিদ পেয়েছেন চার হাজার ৮৫, সিরাজগঞ্জের জেলার শাহজাদপুরে খন্দকার ইমরান হোসেন পান এক হাজার ৮৭ ভোট পান।
দলটির ঘাঁটি বরিশালের উজিরপুরে কাজী মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ভোট পান ৬১০ ও বাকেরগঞ্জে মাওলানা খলিলুর রহমান পান দুই হাজার ৪১১ ভোট। তিনি এই পৌরসভায় দ্বিতীয় হয়েছেন।
ঢাকার ধামরাইয়ে শওকত আলী পান ২৭২ ভোট, পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় নূরুল ইসলাম পান ৫৭০ ভোট।
সবচেয়ে বেশি ভোট পান চুয়াডাঙ্গার তুষার ইমরান সরকার। তার বাক্সে পড়ে চার হাজার ৫৯৭ ভোট।
ইসলামী আন্দোলনের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম নিউজবাংলাকে জানান, তারা ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ভোটে ৬১ পৌরসভার মধ্যে ২৯ জন ও তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৪ পৌরসভায় ৩৩ জন প্রার্থী দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আশাবাদী বলেই তো আমরা প্রার্থী দিয়েছি। এখন মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরিবর্তন চায়। আমরা মনে করছি মানুষ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে আমাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করবে।
‘আমরা তো মনে করি আমরা যেহেতু ইসলামী দলের মধ্যে একমাত্র প্রার্থী দিয়েছি। শুধুমাত্র আমাদের শক্তি দিয়ে নয়, মুসলমানদের ভোট আমরা পাব।’
ভোটের বাক্সে সাড়া নেই। অথচ ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে দেয়ার স্বপ্ন দেখে খেলাফতে মজলিস। ছবি: নিউজবাংলা
কিন্তু আপনারা যেভাবে বলেন, সেভাবে ভোট তো পান না- এমন প্রশ্নে এই নেতা বলেন, ‘এবারের নির্বাচনেও কিন্তু আমাদের প্রার্থীদের বল প্রয়োগ করে হুমকি দেয়া হয়েছে।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভায় প্রার্থী দিয়ে আলোচনাতে আসতে পারেনি। দলের প্রার্থী লোকমান আহমদ ৪৩৩ ভোট পেয়েছেন। তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
জমিয়তের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে আমরা প্রার্থী দিচ্ছি। এ বিষয়ে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত আছে। তবে কয়টিতে প্রার্থী দেয়া হয়েছে আমি বলতে পারছি না।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর একাংশের নেতা মুফতি ওয়াক্কাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পৌর নির্বাচনে প্রার্থী দেইনি।’
কী কারণে দেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব দল তো পৌর নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। আমরাও তাই দেইনি।’
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে আলোচনায় আসা হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিস কোনো পৌরসভায় প্রার্থী দেয়নি।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুর রহমান হেলাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত যে, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করব না।’
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্র থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ নেই। এ কারণে আমরা প্রার্থী দেইনি।
২০ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে খেলাফত মজলিস। দলটির দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক আব্দুল জলিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পৌরসভা নির্বাচন বয়কট করছি এমন ঘোষণা দেইনি। তবে মেয়র পদে প্রার্থী দেইনি। কিন্তু অন্য পদে আমাদের প্রার্থী রয়েছে।‘
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়র প্রার্থী হতে ইচ্ছুক এমন লোক রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা এমন আশঙ্কা রয়েছে।’
তাহলে মেয়র বাদে অন্য পদে কেন নির্বাচন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রার্থী নাই বিষয়টি এমন নয়।’
আওয়ামী লীগের সমর্থনে ১৪ দলীয় জোটের শরিক তরিকত ফেডারেশনের এক জন সংসদ সদস্য রয়েছে। কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি তারাও।
চলমান পৌর নির্বাচন প্রসঙ্গে দলটির সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী নিউজবাংলাকে জানান, ‘পৌরসভা নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছি। মেয়র হিসেবে আমরা কোন প্রার্থী দেইনি।’
তিনি বলেন, ‘এই মূহুর্তে তরিকত ফেডারেশ মনে করে ১৪ দলকে শক্তিশালী করা দরকার।’
গোলাপফুল প্রতীক নিয়ে বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয় জাকের পার্টি। দলটির একটি সমর্থক গোষ্ঠী থাকলেও ভোটের মাঠে তেমন সুবিধা করতে পারে নি দলটি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৯০টি আসনে প্রার্থী দেয় জাকের পার্টি। কিন্তু কেউ বলার মতো ভোট পায়নি।
গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে কতটুকু সন্তুষ্ট- জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব এজাজুর রসুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আসন পাইতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাদের কেউ যদি আসন না পায় আমাদের তাতে দুঃখ নেই।’
দলের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়েছে, এমন দাবিও করেন এই নেতা।
তাহলে ভোটে প্রতিফলন নেই কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেউ ভোট পাইল কি না, সেটা আমাদের হিসাব না। আমাদের উদ্দেশ্য হইলো নির্বাচনী প্রসেসকে সংহত করা।’
জাতীয় নির্বাচনে বড় দলের সমর্থন পেতে তোড়জোর
২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে ইসলামী ঐক্যজোট চারটি আসনে জয়ের পর থেকে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বড় দুই দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য নানা চেষ্টা করে আসছে।
দলগুলো এমন সব সংখ্যায় আসন দাবি করে, তা নিয়ে তাদের শরিকরা নানা সময় বিরক্তিও প্রকাশ করেছে।
২০০৭ সালের বাতিল হওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জোটে যোগ দিয়ে খেলাফত মজলিস ছয়টি আসন চেয়েছিল।
গত নির্বাচনে বিএনপির কাছে ২০টির বেশি আসন দাবি করে জামায়াত ছাড়া ধর্মভিত্তিক বাকি দলগুলো।
আওয়ামী লীগের কাছেও ২০টির বেশি আসন দাবি করে তার ধর্মভিত্তিক দলের শরিকরা।