সদ্য জন্ম নেয়া পাকিস্তানের ছাত্রদের অধিকার আদায়ে একটি সংগঠন করার স্বপ্ন দেখলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে জন্ম হয় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের।
সেই সময় সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পরে মুসলিম শব্দটি নাম থেকে বাদ দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর সংগঠনের নাম রাখা হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বিভিন্ন সময় শুধু ছাত্র অধিকারই নয়, ভাষা আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এই ছাত্র সংগঠন।
বায়ান্নতে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল জোরালো। সংগঠনের বেশ কয়েক জন নেতাকর্মী পুলিশের হাতে আটকও হন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা যে মিছিল বের করে, সেটি আয়োজনে বড় ভূমিকা রাখেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
আন্দোলনের মাধ্যমে আধিকার রক্ষার ধারায় পরবর্তী সময়ে সাতান্নর শিক্ষক ধর্মঘট, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অগ্রণী ভূমিকা রাখে ছাত্রলীগ। ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা গঠন করে মুজিব বাহিনী।
স্বাধীনতার পরও আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে রাজপথে সোচ্চার ছিল এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে ছিল সক্রিয়।
১৯৯৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নানা দুর্যোগে আওয়ামী লীগের সহযোগী শক্তি হিসেবে ত্রাণ দেয়া বা সামাজিক নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও দেখা গেছে ছাত্রলীগকে।
তবে এই গর্বের অতীতের সঙ্গে এখনকার সংগঠনকে মেলানো কঠিন। নব্বইয়ের দশক থেকেই পত্র-পত্রিকার নেতিবাচক শিরোনামে আসে ছাত্রলীগের নাম। অন্তর্কলহ আর সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এখনও নিজেদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে লড়ছে ঐতিহাসিক এ সংগঠনটি।
বিশেষ করে গত এক যুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনখারাবির সঙ্গে নাম এসেছে ছাত্রলীগের।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিশ্বজিৎ দাস নামে এক তরুণকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তুমুল সমালোচিত হয় সংগঠনটি। এর দায়ে ফাঁসিসহ নানা মেয়াদে সাজাও হয়েছে একাধিক কর্মীর।
গত কয়েক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে সংগঠনের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ হারাতে হয়েছে।
প্রথম বারের মতো দুই শীর্ষ নেতা বহিষ্কার হওয়ার পর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই দুই নেতা দায়িত্বে আসার পরও দুটি ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্র সংগঠনটি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা এবং সিলেটের এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় সংগঠনের কয়েক জনের নাম আসায় নিন্দা হয়।
তবে ছাত্রলীগ এই দুই ঘটনার দায় নিজেদের ওপর নেয়নি। বিশেষ করে আবরার হত্যার ঘটনায় ক্ষমা চেয়ে আল নাহিয়ান জয়ের বক্তব্য সে সময় আলোচিত হয়। আর দুই ঘটনাতেই আসামিরা গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের মুখোমুখি। তাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি ছাত্রলীগ।
সংগঠনের সাবেক নেতারাও বলছেন, ছাত্রলীগকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিহার করে আদর্শিক ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ সংগঠন ছাত্রলীগ। জন্মের পর থেকেই ভাষা, সংস্কৃতিসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে পৃথিবীতে খুব সংগঠনই রয়েছে যাদের এ রকম ইতিহাস আছে।’
তিনি ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। এখন শিক্ষার্থীদের অধিকারেও কোনো স্লোগান দিতে হয় না। সেটিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন। সন্ত্রাসের রাজত্বও এখন আর নেই।
‘গৌরব ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে শিক্ষা শান্তি প্রগতি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করে একে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর অর্জন ও ভাবমূর্তি যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।’
শামীম বলেন, ‘ছাত্র সংগঠন নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। আমরাও বিব্রত হই। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রলীগ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক। ছাত্রলীগকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ছাত্ররা ছাত্রলীগকে ভালোবাসে।’
ছাত্রলীগের আরেক সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ অবশ্য মনে করেন, বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগকে গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক সময় অনেক ছোট ঘটনাও অনেক ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ছাত্রলীগ ভিক্টিমাইজও হয়েছে। সাবেক হিসেবে আমি সবসময় ছাত্রলীগের পজিটিভ জিনিসগুলোই দেখি।’
সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্ব ছাত্রলীগকে আরও এগিয়ে নেবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি
প্রতি বছর ঘটা করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করলেও এবার করোনাভাইরাসের কারণে তেমন কোনো আয়োজন নেই।
সকাল আটটায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এরপর সকাল নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটা হবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক।
আর বিকাল ৪টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। এতে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আলোচনা অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের বর্তমান নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেকরাও অংশ নেবেন। করোনার কারণে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’