হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সেই ঘাঁটিতে পৌরসভা নির্বাচনে সোমবার বিএনপির কাছে হেরে গেছে আওয়ামী লীগ। কেন হারল আওয়ামী লীগ, সেই জল্পনা চলছে জেলা জুড়ে।
এর মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দলের তিন নেতার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকাকে। তাদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় অল্প ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগের মাসুদুজ্জামান মাসুক।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বিদ্রোহী তিন প্রার্থীই শুধু আওয়ামী লীগের হারের কারণ নয়, প্রার্থীরও রয়েছে ত্রুটি। হারের পেছনে দলের শক্ত অবস্থা না নিতে পারাকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ।
তিন বিদ্রোহীতে ধরা আওয়ামী লীগ
শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় মোট ভোটার ১৮ হাজার ৩৫ জন। সোমবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৩ হাজার ২৮৭টি। বৈধ ভোটের সংখ্যা ১৩ হাজার ২৪৩টি, বাতিল হয়েছে ৪৪ ভোট। অর্থাৎ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বিএনপির ফরিদ আহমেদ অলি ধানের শীষ প্রতীকে ৪ হাজার ৪১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকে মাসুদুজ্জামান পান ৩ হাজার ১৪১ ভোট। দুজনের ভোটের ব্যবধান ৯০০।
নৌকাকে হারিয়ে নির্বাচিত বিএনপির মেয়র ফরিদ আহমেদ অলি। ছবি: নিউজবাংলা
নির্বাচনে বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছালেক মিয়া পেয়েছেন ২ হাজার ৫৯৯ ভোট। দলের অপর দুই বিদ্রোহী ফজল উদ্দিন তালুকদার পেয়েছেন ১ হাজার ৫১০ ভোট ও আবুল কাশেম ১ হাজার ৪৩০ ভোট।
দলটির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, যদি আওয়ামী লীগ থেকে এক জন বিদ্রোহী প্রার্থী কম হতো তাহলেও শায়েস্তাগঞ্জ নৌকার দখলে থাকত। কেননা তিন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে পেয়েছেন ৫ হাজার ৫৩৯ ভোট। আর আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলে এই তিন জনের প্রাপ্ত ভোট মাসুদুজ্জামান পেলে তার ভোট দাঁড়াত ৮ হাজার ৬৮০টি, যা ধানের শীষের প্রায় দ্বিগুণ।
তাই বিদ্রোহী প্রার্থী না ঠেকাতে পারাকেই দুষছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
সমস্যা ছিল প্রার্থীরও
আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ হিসেবে নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়নের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, মাসুদুজ্জামান পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদ্যসাবেক মেয়র ছালেক মিয়াসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব ঘোঁচানোর চেষ্টা করেননি মাসুদুজ্জামান। সেই সুযোগে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ছালেক মিয়া বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
মাসুদুজ্জামান ৩নং ওয়ার্ডে তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর। সেই সুবাদে ওয়ার্ডে জনপ্রিয়তা ছিল তার। মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় তার পথ সুগম হয়েছিল। কিন্তু নেতাকর্মীদের অমূল্যায়ন শুরু করেন। তাই অনেক কর্মী ভেড়েন বিদ্রোহী শিবিরে।
মাসুদুজ্জামান অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমার পরাজয়ের একমাত্র কারণ বিদ্রোহীরা। আওয়ামী লীগ থেকে তিন জন প্রার্থী বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন না করলে আমি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হতাম।’
বিদ্রোহী ঠেকাতে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ, একাট্টা বিএনপি
একক প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ। প্রথম পর্যায়ে মনোনয়নের জন্য শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কেন্দ্রে ছয় জনের নাম পাঠায় জেলা আওয়ামী লীগ। ২৮ নভেম্বর কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় মাসুদুজ্জামান মাসুককে।
কেন্দ্রের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে তখন আওয়ামী লীগের চার নেতা নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে চার নেতাকে নিয়ে সমঝোতায় বসেছিল জেলা আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুরাহা হয়নি।
চার জনের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের মনোনয়নপত্রে ত্রুটি থাকায় তা বাতিল করে দেয় কমিশন।
৯ ডিসেম্বর বিদ্রোহী তিন প্রার্থী ছালেক মিয়া, ফজল উদ্দিন ও আবুল কাশেমকে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় সমঝোতায় বসলেও ব্যর্থ হয় জেলা কমিটি।
পরাজিত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুক। ছবি: নিউজবাংলা
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্রোহীর কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিভক্তির সুযোগ নেয় বিএনপি। দলটির প্রার্থী ফরিদ আহমেদ অলি আগে দুই দফা মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমবার তার বাবার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। পরেরবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র হন তিনি।
এই নির্বাচনে পৌরসভাকে নিজেদের দখলে নিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে শক্তিশালী কমিটি করে জেলা বিএনপি। মনোনয়ন পাওয়ার পর তার সঙ্গেই ছিল বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মী।
বিজয়ী ফরিদ আহমেদ অলি বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর পর মেয়র নির্বাচিত হই। তখন পৌরসভার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ শুরু করি। শিশু পার্ক, বিনোদন পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেই।
‘এ সময় অসংখ্য রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেছি। আমার সময়ে উন্নয়নে পৌরবাসী মুগ্ধ হয়েছিল। সেই উন্নয়নের কথা এখনও জনগণ ভোলেনি। সে কারণেই আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন।’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জি কে গউছ বলেন, ‘শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় শুধু ধানের শীষের বিজয় হয়নি, গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে শায়েস্তাগঞ্জবাসী প্রমাণ করেছেন, জনগণের সামনে কোনো অপশক্তি দাঁড়াতে পারে না।’