চলতি বছর বিএনপির জন্য এক দিক দিয়ে স্বস্তির, আবার অন্য দিক দিয়ে অস্বস্তির গেছে। স্বস্তির এ কারণে যে, তাদের দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আর অস্বস্তি হচ্ছে মুক্তির প্রক্রিয়া।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি রাজপথের আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ে তাকে মুক্ত করে আনার কথা বলেছিল।
তবে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে গিয়ে উল্টো পাঁচ বছরের সাজা ১০ বছর হয়েছে। আবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাজা হয়েছে সাত বছর।
আইনি লড়াইয়ে ব্যর্থতার পর উদ্যোগী হয় খালেদা জিয়ার পরিবার। তার ভাই-বোনের আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করিয়ে গত ২৫ মার্চ মুক্তি দেয়া হয় ছয় মাসের জন্য। এরপর মুক্তির মেয়াদ বাড়ে আরও ছয় মাসের জন্য।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর খালেদা জিয়া রাজনীতি নিয়ে একদম মাথা ঘামাচ্ছেন না। কোনো বক্তব্য, বিবৃতি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসেনি তার পক্ষ থেকে। এমনকি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসগুলোতেও তিনি নীরব। জনগণকে শুভেচ্ছা জানাননি তিনি।
বিএনপি এই মুক্তি নিয়ে এতটাই অস্বস্তিতে যে, নেত্রীর মুক্তিতে দলের ভূমিকা অস্বীকার করা হচ্ছে। বিএনপি বারবার বলছে, পারিবারিক আবেদনের সঙ্গে দলের সম্পৃক্ততা নেই।
খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কানদার কী আর্জি নিয়ে গিয়েছিলেন, এ বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে পরিবারও কথা বলতে রাজি নয়। বিএনপি নেতাদের মতো তারাও গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন এই বিষয়ে।
শামীম এস্কান্দারকে ফোন করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলব না।’
একই প্রসঙ্গে তার ছোট বোন সেলিনা ইসলাম প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য বিষয়ে কথা বলতে থাকেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগম জিয়া কখনও আপসের পক্ষে ছিলেন না। আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা ছিল।’
তাহলে পরিবার থেকে কেন এমন আবেদন- জানতে চাইলে বিএনপি নেত্রীর পক্ষে আদালতে আইনি লড়াই চালানো এই নেতা বলেন, ‘পরিবার মানবিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করে। সরকার তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে নির্বাহী আদেশে তাকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করেন। এটা সরকার আর পরিবার ভালো জানবে।’
সরকারি দল ও জাতীয় পার্টির কটাক্ষ, জবাব নেই বিএনপির
খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে প্রায়ই নানা কটাক্ষ শুনতে হচ্ছে বিএনপিকে।
গত ২ ডিসেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চার লেনের দ্বিতীয় নয়ারহাট সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের আয়োজনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার অনুগ্রহেই খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত হলেও বিএনপি এমন একটি দল, যাদের কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই।’
গত ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃপায় বেগম জিয়া বাইরে আছেন।’
জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়াম্যান জি এম কাদেরও এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
গত ১৩ ডিসেম্বর দলীয় কার্যালয়ে এক সভায় তিনি বলেন, মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন খালেদা জিয়া।
১১ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে জাপা নেতা হাসির ছলে বলেন, ‘বেগম জিয়া আর আপসহীন নেত্রী নন। সরকারের সঙ্গে আপস করে কারাগার থেকে বের হয়েছেন।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি পরিবারের এই মানবিক আবেদনের সঙ্গে দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটি পরিবারের ইমোশনের বিষয়, তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’
তবে খালেদা জিয়ার বোন সেলিনা ইসলাম বলেন, মুচলেকায় মুক্তির বিষয় নিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট হলেও তা নিয়ে ভাবছেন না তারা। তারা খালেদা জিয়ার সুস্থতা নিয়েই ভাবছেন। আর তার জন্য দল কী ভাবছে বা করবে তা একেবারেই বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
কী শর্ত?
খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। ১. তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, ২. তিনি চিকিৎসা নেবেন নিজের ঘরে। তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারবেন না, এমন কোনো শর্তের কথা বলেনি কোনো পক্ষই।
গত সেপ্টেম্বরে মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর সময়ও একই শর্তের কথা তুলে ধরা হয়।
তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন কোনো শর্তের কথা কোনো পক্ষই বলেনি। তার পরেও খালেদা জিয়ার নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খালেদা জিয়া কি রাজনীতি থেকে সরে গেলেন, এমন প্রশ্নে গত ১৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘উনি রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাবের নাম। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে কখনও সরে যাননি এবং যাবেন না।…আমরা মনে করি, উনি আছেন, উনি থাকবেন। যখনই উনি সুস্থ হবেন, বেরিয়ে আসবেন অবশ্যই উনি অ্যাকটিভ হবেন।’
খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে সরে যাননি বলে ফখরুল দাবি করলেও একটি প্রশ্নের জবাব বিএনপি দিচ্ছে না। বিএনপি নেত্রী কারাগারের বাইরে থাকা অবস্থাতেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কেন তারেক রহমান, তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
দেশের বাইরে থেকে খালেদা জিয়ার ছেলেই দলীয় সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, বিভিন্ন বৈঠকে প্রধান বক্তার ভূমিকায় আছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগম জিয়া তো এখনও মুক্ত নন। দৃশ্যমান শর্তের বাইরেও আরও শর্ত রয়েছে, যেগুলো গণমাধ্যমও খুঁজে বের করেন না। তাকে কারাগারে রাখা আর গৃহে বন্দি করা একই কথা।’
আর কী শর্ত রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা খুঁজে বের করেন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাকে তো রাজনীতি করার মতো অবস্থায় রাখা হয়নি। তার শারীরিক অবস্থা যা ছিল, দিন দিন খারাপের পথে যাচ্ছে। এখনও বেঁচে আছেন তাই বেশি।’
এখন যেমন আছেন ফিরোজায়
সাময়িক মুক্তির পর বেগম জিয়া অবস্থান করছেন গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায়।
কেমন আছেন ৭৫ বছর বয়সী তিনবারের প্রধানমন্ত্রী?
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে চোখ ও দাঁতের সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। মুক্তি পেলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এখনও তার উন্নত চিকিৎসা শুরু হয়নি।
ছোট বোন সেলিনা ইসলাম বলেন, ‘শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো না। দেশে যতটুক সম্ভব করা যায় করা হচ্ছে। বিদেশে নিলে তিনি হয়তো দ্রুত সুস্থ হতেন।’
তিনি বলেন, ‘বেগম জিয়ার শরীরের গিরায় গিরায় এখনো ব্যথা কমেনি। একা দাঁড়াতেও পারছেন না, হাঁটাচলাও করতে পারছেন না। বিছানা থেকে বাথরুমে যেতেও তাঁর অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। এমনকি খাবার খেতেও সহায়তা নিতে হয়। রুম থেকে ড্রয়িং রুমে বা রিডিং রুমে যেতেও সহায়তা লাগে।’
বিএনপি নেত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কারাগারে থাকা অবস্থায় শরীর যেমন ছিল, এখন তার থেকে একটু উন্নত। তবে বাতের ব্যথা আর ডায়াবেটিসটাই বেশি ভোগাচ্ছেন তাকে। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে।’
তিনি বলেন, “খালেদা জিয়ার শারীরিক বড় সমস্যা হলো বাতের ব্যাথা, যে কারণে হাঁটতে পারেন না তিনি। এ জন্য ওষুধের পাশাপাশি ‘হটওয়াটার’ থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। ব্যাথার রোগীদের জন্য এটা বেশ উপকারে আসে।”
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের বাইরে দুজন চিকিৎসক আপাতত চেয়ারপারসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। অন্য কেউ এখন অ্যালাউড না।’
বেগম জিয়ার সার্বক্ষণিক সঙ্গী গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগম আর একজন নার্স। লন্ডনে বসে প্রতিনিয়ত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান।
অবসরে খালেদা জিয়া খুটিয়ে খুটিয়ে পত্রিকা পড়েন বলে জানিয়েছেন তার প্রেস উইংয়ের এক সদস্য। এ জন্য মূলধারার সব পত্রিকা তার বাসায় বান্ডিল করে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এ ছাড়া লন্ডনে থাকা বড় ছেলে তারেক রহমান, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলেও সময় কাটান তিনি। মাঝে-মধ্যে বড় ভাই সাইদ এস্কান্দারের পরিবার, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের পরিবার, সেজো বোন সেলিনা ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও বাসায় কথাবার্তা বলে সময় কাটে খালেদা জিয়ার।