বিএনপি এখন কার নিয়ন্ত্রণে? খালেদা জিয়া নাকি তারেক রহমানের?
এই প্রশ্ন উঠার কারণ দুর্নীতির দুই মামলায় সাজা নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় মুক্ত চেয়ারপারসন দল নিয়ে দৃশ্যত নীরব। সব সিদ্ধান্ত অনুমোদন করছেন একাধিক মামলায় সাজা নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।
খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে থাকা অবস্থায় তারেকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন পদ থাকা নিয়েও দলটি কিছু বলছে না।
বিএনপি পরিচালনায় মা-ছেলের মধ্যে চিন্তা ভাবনায় পার্থক্য নিয়ে আলোচনা চলছে সেই ২০০১ সাল থেকেই।
ওই বছরে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতির দৃশ্যপটে আসেন। এর আগ পর্যন্ত খালেদা বলয়ের বাইরে বিএনপিতে কোনো কিছু চিন্তা করা অসম্ভব হলেও তখন থেকেই তারেক বলয় নিয়ে আলোচনা চলছে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে আর ফেরেননি তারেক রহমান। এর মধ্যে দুর্নীতির একাধিক মামলার পাশাপাশি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজা হয়েছে তার।
শুক্রবার প্রবাসী নেতার জন্মদিন পালন করছে বিএনপি। যদিও করোনাকালে কেক কাটাসহ জমকালো কোনো আয়োজন রাখা হয়নি।
তারেক রহমানের জন্মদিনকে সামনে রেখে দলে বিভেদের বিষয়টি সামনে আসছে নতুন করে।
দলে কোনো বলয়ের প্রতি আগ্রহ নেই, এমন একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বর্তমান সংসদে বিএনপির নির্বাচিত যোগদানের বিষয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমানের চিন্তাভাবনার পার্থক্য ছিল।
৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার পর নাটকীয়ভাবে সংসদে যোগ দেয় বিএনপি। শেষ মুহূর্তে লন্ডন থেকে এ সিদ্ধান্ত দেন তারেক রহমান। পরে খালেদা জিয়া এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
গত মার্চে বিশেষ বিবেচনায় মুক্তির পর থেকে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসছেন না বেগম খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া দণ্ডিত হওয়ার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পান তারেক রহমান। সেই থেকে দলটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন তিনি। তবে প্রায়ই দলের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কার সেটি নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
গত বছর ছাত্রদলের একটি কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এরকম একটি বিভেদ সৃষ্টি হয় বলে জানাচ্ছেন নেতারা।
গত ১৩ জুন রাতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে’ ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে কথা হয়। বৈঠক চলাকালে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সদ্য বাতিল হওয়া ছাত্রদলের কমিটির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুমতি ছাড়া ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্তে তারা কারাগারে খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন বিষয়টি নিয়ে ‘হ্যাঁ’ও বলেননি, ’না’ও বলেননি। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় চার বছর যাবত কোনো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলি না। আপনি চেক করে দেখতে পারেন।’
২০১৮ সালের নির্বাচনে ২০ দলের শরিক স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের ‘ধানের শীষ’ প্রতীক দেওয়া নিয়েও বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে মতের অমিলের তথ্য আছে।
তারেক রহমানসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জামায়াতকে ধানের শীষ দিতে চাননি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কারাগার থেকে খালেদা জিয়ার বার্তা আসে জামায়াতকে ধানের শীষ দেওয়ার।
স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘জামায়াতকে ছাড়ার জন্য চাপ আছে তা সত্য। কিন্তু, ঐক্যের লক্ষ্যেই জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছিল।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপিতে দলের একটি অংশ যে বিদ্রোহ করে ‘সংস্কারপন্থী’ নাম নিয়ে সক্রিয় হয়, তার পেছনে তারেক রহমানের কর্তৃত্ব মানতে না পারার কথা খোলাখুলিই বলা হয়েছিল।
লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমান স্কাইপে দলের শীর্ষ বৈঠকগুলোতে যোগ দিচ্ছেন
সংস্কারপন্থীরা দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারার পর বেশিরভাগ বশ্যতা স্বীকার করে দলে ফিরেছেন। তারা চাইছেন খালেদা জিয়া আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হোন।
তারেক সমর্থকরা যুক্তি দিচ্ছেন, গত তিনটি নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল পরিচালিত হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। তাদের অভিযোগ, জ্যেষ্ঠ বেশিরভাগ নেতা তারেক রহমানের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য কাজ করেন না, বরং আড়ালে তাঁর সমালোচনা করেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম গোপনের শর্তে বলেন, ‘মা-ছেলের দ্বন্দ্বের কারণেই বিএনপি আজ ভগ্নদশায়। একজন অসুস্থ, আরেকজন বিদেশে। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। নীতি-নির্ধারণের জায়গায় অসুস্থ ও বয়স্কদের সরিয়ে নতুনদের আনতে হবে। যারা দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ রাখতে পারবেন।’
যদিও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দলে এ ধরনের বিভেদ আমরা এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করিনি। অনুভবও করিনি। বিএনপি মানেই খালেদা, বিএনপি মানেই তারেক। যা খালেদা, তাই তারেক।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা এ ধরনের অভিযোগ তুলছেন তারা আসলে কোনো একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান। এই যে তারা বলছেন, দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব মানেই দূরত্ব। এতে করে বিএনপি আরও অস্তিত্বহীনতায় পরে যাবে।‘
খালেদা জিয়া মুক্ত থাকা স্বত্ত্বেও তারেক রহমান দলটির চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে রয়েছেন কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে গয়েশ্বর বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারেক রহমান এ দায়িত্ব পেয়েছেন। ম্যাডামের অনুপস্থতিতে তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দলকে সক্রিয় রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে তা গঠনতন্ত্রের বাইরে নয়।’
খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে এলে তারই তো আবার দলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া কথা। তাহলে আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন কেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেউই ম্যাডামের মুক্তির পেছনের সকল শর্তকে সামনে আনতে পারেননি। আমিও বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলব। এই যে বলা হয়েছে তিনি চিকিৎসা পর্যন্ত ঘরে বসে করবেন। এর মানে কী দাঁড়ায়?
‘তিনি এখনও এক রকম বন্দিই আছেন। সেই অবস্থায় তিনি কীভাবে দলের দায়িত্ব নেবেন?’
সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিএনপির জন্য দুজনকেই সমানভাবে দরকার। যারা দীর্ঘদিন যাবত দলের অনুসারী, তারা খালেদা জিয়াকে এক অনন্য জায়গা দিয়ে রেখেছেন। তাই তাদের মন রাখতে খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনেক বেশি।
আবার তিনি যেহেতু অসুস্থ, আরও কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। সেক্ষেত্রে দলে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে এমন কাউকে দরকার। আর এই মুহূর্ত তার জন্য উপযুক্ত হলেন তারেক রহমান।’
পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, চলতি বছরেও প্রার্থী বদল নিয়ে রাগ অভিমান পর্ব চলে মা-ছেলের মধ্যে। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে তারেক রহমান চেয়েছিলেন মনোনয়ন পাবেন নবীউল্লাহর নবী। তবে খালেদা জিয়ার পছন্দ ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
যদিও স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক এমন নয়। উনি (তারেক রহমান) ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত নেন। আমরাও তাকে বলি আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন।’
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী এম শাহজাহান ওমর স্পষ্টত খালেদা জিয়ার পক্ষে। তিনি বলেন, ‘তারেক সাহেব থাকেন লন্ডনে। লন্ডনে বসে কথা বলা বা ভাব আদান-প্রদান করা তো ডিফিকাল্ট জব। মাঝে মাঝে তিনি স্কাইপে কথা বলেন। এতে পার্টিকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? তারেক সাহেব কতখানি চালাতে পারবেন, আপনারাও দেখেন, আমিও দেখি।’
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, ‘শাহজাহান ওমরের বক্তব্যের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আমাদের ঐক্যের প্রতীক। তিনি কখনোই মনেপ্রাণে বিএনপি করেননি। পরিস্থিতির কারণে বিএনপি করেছেন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে কেউ সরিয়ে রাখেননি। তাকে সরানোর এখতিয়ারও কারও নেই। তিনি চাইলে যে কোনো সময় চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিতে পারেন।’