পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঘটনার এক বছরের মধ্যে। কিন্তু বগুড়ায় যুবদল নেতা আরিফুল শেখ ওরফে মোহন হত্যার বিচার শুরুই হয়নি গত এক যুগে। অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়েছে ৮৫ বার। এর মধ্যে কয়েক দফা সরকার বদলেছে। নিহতের পরিবার ছেড়ে গেছে এলাকা। ফলে মামলা এগিয়ে নেয়ার তাগিদ নেই কারো।
বগুড়ায় যুবদল নেতা আরিফুল শেখ ওরফে মোহনকে ২০০৬ সালে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় পরের বছরে সদর থানায় ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক যুবদল কর্মী। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এই মামলা হলেও সমীকরণ পাল্টে যায় মামলার তদন্তে। পরে এই মামলায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলা করে। এর মধ্যে কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। তবে এখনো বিচার শুরু হয়নি।
মোহন হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। কিন্তু আদালত এখনও তা গ্রহণ করেনি। এর মধ্যে পেরিয়েছে মামলার ৮৫ কার্যদিবস।
আদালত ও মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর শহরের যুবদল অফিস চত্বরে বিএনপিপন্থি চারদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। দলীয় কার্যালয়ে এর আয়োজন হলেও এটি শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় ছড়িয়ে যায়। এই এলাকার সপ্তপদী মার্কেটের ছাদে অবস্থান নেয় দুর্বৃত্তরা। এক পর্যায়ে তারা নেতাকর্মীদের দিকে ককটেল ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যায়। যুবদলের ১ নম্বর ওয়ার্ড আঞ্চলিক কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক আরিফুল শেখ ওরফে মোহনকে ছুরিকাঘাত করে সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয় মোহনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে মোহনের মরদেহের ওপর চড়ে উল্লাস করে খুনিরা। এ ঘটনায় তৎকালীন যুবদল কর্মী আতাউর রহমান বাদী হয়ে ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
মামলার তদন্ত শুরু করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (বর্তমানে কর্মরত গাজীপুরে) আবদুল মান্নান। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের অবরোধ ছিল। ভিডিওদৃশ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আতাউর রহমানের করা মামলার এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামি হত্যার সঙ্গে জড়িত নয়। তদন্তের এক পর্যায়ে চারজন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর বদলে যায় তদন্তের গতিপথ।
আবদুল মান্নানের দেয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল আসামিদের আড়াল করতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের আসামি করেন আতাউর রহমান। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন আবদুল মান্নান। অভিযুক্তরা হলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক সাংসদ হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাইফুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ার, জাকিউল্লা ওরফে আপেল ও খায়রুল বাশার। এছাড়া আছেন শাহ আলম ওরফে ককটেল আলম, সোনা মিয়া, জেলহজ ওরফে জুলহক, মো. আতাউর রহমান ওরফে শম্ভু, মো. মিজানুর রহমান ও জহুরুল ইসলাম।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, চার্জশিটভুক্ত আসামি সাইফুল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিচারে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন উচ্চ আদালত থেকে। মিজানুরসহ অন্য দুই আসামি পলাতক রয়েছেন। এই মামলা চার্জ গঠনের জন্য আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ দফায় পরিবর্তন হয়েছে অভিযোগ গঠনের তারিখ।
তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র ২০০৭ সালে দেয়া হয়। এজাহারের বাইরে অনেক নাম পাওয়া গেছে অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তি ও টেলিভিশনের ভিডিওদৃশ্য থেকে।
মামলার বিচারকাজ শুরু কেন হচ্ছে না, জানতে চাইলে বগুড়া জজ আদালতের সরকারি কৌসুলী আবদুল মতিন বলেন, শুরু থেকেই গুরুত্ব সহকারে মামলাটি দেখা হচ্ছে। মূলত বিচারক সংকটের কারণে এই মামলা এখন ঝুলে আছে।
‘খোঁজ নেই’ মোহনের পরিবারের কারও
মোহন তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বগুড়া পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের গোয়ালগাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন। ছেলেকে হারানোর কিছুদিন পর মা মারা যান। বাবা শহরের অন্য এলাকায় বিয়ে করেছেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মোহনের পরিবার যে বাড়িতে থাকতেন তা বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ৮ বছর আগে।
মোহন হত্যার সময় এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমু। তিনি বলেন, এই এলাকায় থেকে বাড়িঘর বিক্রি করার পর মোহনের পরিবারের কারও খোঁজখবর নেই। এই কারণে মামলারও কেউ খবর নেয় না।