পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) প্রশাসনের ১৪ কর্মকর্তার নিয়োগে বড় অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুদকের পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক তানভীর আহমেদকে এ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো চিঠিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, প্রশাসনিক অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ছাড়পত্র, আবেদনকারীদের তালিকা ও বাছাই কমিটির নথি জমা দিতে বলা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাবশালী নেতা, সাংসদ, সচিব ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের মাধ্যমে ৮ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে কর্মকর্তাদের নাম, পদবি এবং টাকার অঙ্ক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।
ডেপুটি রেজিস্ট্রার তাজবির হোসেন সুমন ২০ লাখ, সহকারী রেজিস্ট্রার অ্যানি চক্রবর্তী ২০ লাখ, উপপরিচালক বেল্লাল হোসেন ১২ লাখ, সহকারী পরিচালক রাশেদুল করিম ৮ লাখ, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তুহিন সিকদার ১৮ লাখ, উপপরিচালক রাজিব মিয়া ২০ লাখ, প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তা মশিউর রহমান ১৭ লাখ, ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ইলিয়াছ ১৮ লাখ, ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ২০ লাখ, সহকারী পরিচালক নাদিমুজ্জামান ১২ লাখ, ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা আখিনুর বেগম ১০ লাখ, সহকারী পরিচালক আবু সুয়েম ১৮ লাখ, টেকনিক্যাল কর্মকর্তা মাধব চন্দ্র দাস ২০ লাখ, উপপরিচালক (অডিট) মনিরুজ্জামান খান রাজনৈতিক কোটা।
দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে ঢাকায় প্রশিক্ষণে থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. ইকতিয়ার উদ্দিন বলেন, ‘দুদকের অনুরোধ অনুযায়ী নথি প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে একসঙ্গে অনেক তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে আমরা কিছুটা সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি।’
দক্ষিণবঙ্গের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পবিপ্রবি শিক্ষার্থীবান্ধব ও গবেষণায় পেয়েছ সাফল্য। কিন্তু গত আওয়ামী সরকারের সময় নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাধারণরা মনে করেন, টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিরা কখনো যোগ্যতা বা নৈতিকতার প্রতীক হতে পারেন না। এতে একদিকে দক্ষ মানবসম্পদ বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য বাংলাদেশের নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের অন্যতম বড় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ ও আত্মীয়কোটা। ফলে মেধাবী প্রার্থীরা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, প্রশাসনিক কাঠামোতে দুর্নীতির শেকড় গভীর হচ্ছে, রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ হারাচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না মানসম্মত সেবা ও গবেষণা সহায়তা।
শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও নাগরিক সমাজ একবাক্যে বলছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অবিলম্বে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ঘুষ দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
তাদের মতে, শুধু তদন্ত নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া বিকল্প নেই। অন্যথায় মেধা ও নৈতিকতার পরিবর্তে দুর্নীতি ও অর্থশক্তিই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেবে।
পবিপ্রবির নিয়োগ অনিয়মের ঘটনা শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়; বরং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতের গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। এখনই যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্মের শিক্ষা, গবেষণা ও নৈতিকতা সবকিছুই বিপন্ন হয়ে পড়বে।