বাংলাদেশের একসময় পাট শিল্প ছিল অর্থনৈতিক চাবিকাঠি, সারা বাংলাদেশের ন্যায় কুমিল্লার অঞ্চলের অধিকাংশ উপজেলার কৃষকরা পাট চাষ করত। বর্তমান সময়ে নানান কারণে অধিকাংশ এলাকায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে চাষীরা। কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, অতীতের ন্যায় বর্ষা মৌসুমে পানি না থাকা এবং পাটজাত পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় চাষিরা আগ্রহ হারাচ্ছে। কুমিল্লার সর্ববৃহৎ পাটের বাজার ছিল গৌরীপুর, রামচন্দপুর, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সাহেবাবাদ, চান্দলা, সিদলাই, দুলালপুরসহ বিভিন্ন হাট। এগুলোতে পাটের আড়তদার ছিল, ময়াল থেকে বড় বড় গহনা, কবুত কুসা, সরাঙ্গ নৌকা নিয়ে গ্রামের কৃষক দের কাছ থেকে পাট কিনে পাট ব্যাবসায়ীরা গুদাম ঘরে রেখে নারায়ণগঞ্জ শীতালক্ষার নদীর তীরে নিতাইগঞ্জ পাট বাজারে। বড় বড় আড়তদাররা বিদেশে রপ্তানি করত। আবার কখনো দেশের চাহিদা মেটাত, তখন বিখ্যাত জুট মেইল ছিল নারায়ণগঞ্জের আদমজী, চট্টগ্রামের আমিন জুট মেইল। এই বৃহৎ মেইলগুলোতে পাট শিল্প হারিয়ে যাওয়ার ফেলায় বাংলাদেশের কৃষকরা পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরেজমিনে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদকের চোখ পড়ে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার কৃষকদের নানা সমস্যার চিত্র।
এদিকে, পাট শিল্প ও পাট উৎপাদন নিয়ে কৃষকদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ, তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে পাটের দরপতন, কৃষি উপকরণের মূল্য ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, পাট পঁচানোর পানির অভাব ও শ্রমিক সংকটের কারণেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
চান্দলা, বলাকিয়া, সিদলাই, দুলালপুর, ছাতিয়ানি গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এবং বিভিন্ন সমস্যার কারণ তুলে ধরেন ওই এলাকার কৃষক আবদুল মতিন, হক ভূইয়া, ফারুক আহমেদ, আবদুল কাদেরসহ অনেকেই বলেন, পাটের বদলে রবি ফসল, বোরো ও আমনসহ অন্যান্য লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
ফলে দিন দিন ব্রাহ্মণপাড়াসহ কুমিল্লার নিচু অঞ্চলগুলোতে পাটের আবাদ কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণপাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. মাসুদ রানা বলেন, ব্রাহ্মণপাড়ায় এ বছর ৫৩ হেক্টর লক্ষ্য মাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে পাট চাষের জন্যে, এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩০ হেক্টর। বিভিন্ন ইউনিয়নে গত বছর ভয়াবহ বন্যা হওয়ায় কৃষকেরা পাট চাষ সময় মতো জমি তৈরি করতে পারেনি। এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলো নিচু হওয়ার সময় মতো জমি চাষাবাদ ও তৈরি করতে অনেক কৃষকের বেগ পেতে হয়েছে।
তাই কৃষকেরা পাট চাষে কিছুটা আগ্রহ হারাচ্ছে। পাট চাষিরা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদলাই ইউনিয়ন এর কৃষক আবদুল হান্নান জানান, পাট চাষে খরচ বেশি এছাড়াও কয়েক বছর ধরে বন্যা না হওয়ায় আমরা পাট চাষ করতে সমস্যা হচ্ছে। পাট চাষে আমাদের খরচ পুষে না তাই আমরা পাট চাষের বদলে অন্যান্য ফসল করছি।
ব্রাহ্মণপাড়া সদর ইউনিয়নের আটকিল্লার পাড় গ্রামের কৃষক ইউনুস মিয়া বলেন, পাটের আবাদ করে বেশ কয়েকবার লাভের মুখ দেখতে পারিনি। গত বছর ৩০ শতাংশ জমিতে পাটের আবাদ করলেও, এবার সংসারের প্রয়োজনে জ্বালানি হিসেবে মাত্র ৭ শতাংশ জমিতে পাটের আবাদ করেছি।
দুলালপুর ইউনিয়নের বালিনা গ্রামের কৃষক তাহের মিয়া বলেন, ‘গত দুবছর পাটচাষ করে পানির অভাবে পাট পঁচাতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এছাড়া পাটের আঁশ ছাড়াতে শ্রমিক পাওয়া যায় না।
তিনি আরো বলেন, চাষিদের নিকট থেকে পাট কিনে লাভের একটি বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্থতার ব্যাবসায়ীরা, কারণ অতীতে সরাসরি বাড়িতে পাট ব্যাবসায়ীদের নৌকা আসত, এখন পানি না থাকায় মধ্যেস্থতার কাছে বিক্রি করতে হয়। এ বিষয়ে সচেতন মহলের কয়েকজন বলেন, সোনালী আঁশ পাট এখন কৃষকের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার অচিরেই উদ্যোগ না নিলে গ্রামবাংলা থেকে পাট চাষ হারিয়ে যাবে। সরকারের উচিত কৃষকদের ভর্তুকি দিয়ে পাট চাষিদের বাঁচিয়ে রেখে পাট শিল্পকে উন্নয়ন করে বিদেশে পূর্বের ন্যায় রপ্তানি করে কর্মসংস্থান বাড়ানো।