সিলেটের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর থেকে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে গতকাল বুধবার রাতভর অভিযান পরিচালনা করেছে যৌথবাহিনী। অভিযানে বিভিন্ন স্থান থেকে লুট হওয়া ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করে ফের সাদাপাথর এলাকাসহ ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লুট হওয়া পাথর পরিবহনকারী বেশ কয়েকটি ট্রাক জব্দ করেছে প্রশাসন।
বুধবার (১৩ আগস্ট) দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে সিলেট নগরী ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ এলাকায় জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে এই অভিযান পরিচালনা করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহার বলেন, বুধবার রাতে ৬ সদস্যের একটি দল যৌথবাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করে ফের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরসহ ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, আজ বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ফের অভিযান পরিচালনা করা হবে। লুট হওয়া পাথর উদ্ধার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে বলে জানান তিনি।
এর আগে বুধবার (১৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক জরুরি সমন্বয় সভায় লুট করা পাথর উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে সাদাপাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।
প্রশাসনের জরুরি বৈঠক শেষে রাত ১২টার পর অভিযানে নামে জেলা প্রশাসন ও যৌথবাহিনী। সিলেট নগরী ও সাদাপাথর এলাকায় রাতভর অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযানে বিভিন্ন স্থান থেকে সাদাপাথরের লুট করা স্তুপকৃত পাথর জব্দ করা হয়। পরে সেগুলো সাদাপাথর এলাকায় নিয়ে ফের প্রতিস্থাপন করা হয়।
এছাড়া সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের ওসমানী বিমানবন্দর এলাকায় সিলেট ক্লাবের সামনে যৌথবাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় বেশ কয়েকটি ট্রাক আটকেও পাথর জব্দ করা হয়।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, সাদাপাথর থেকে চুরি হওয়া পাথর উদ্ধারে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। লুট করা পাথর উদ্ধারে যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান থাকবে।
এর আগে, নজিরবিহীন লুটপাটের পর পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর রক্ষায় নড়ে বসে প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউসে জরুরি সমন্বয় সভার আহ্বান করা হয়। সভায় লুট হওয়া পাথর উদ্ধার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। বুধবার রাতে সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
সভায় সাদাপাথর রক্ষায় ৫টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেগুলো হলো:
১. জাফলং ইসিএ এলাকা ও সাদাপাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।
২. গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের চেকপোস্টে যৌথবাহিনীর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি থাকবে।
৩. অবৈধ পাথর ভাঙা (ক্রাশিং) মেশিন বন্ধ ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
৪. পাথর চুরির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
৫. চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে আগের অবস্থানে ফেরানো হবে।
সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করেছে সিলেট জেলা প্রশাসন। কমিটিকে আগামী রোববারের (১৭ আগস্ট) মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর লুটপাটের ঘটনা অনুসন্ধানে গতকাল সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল।
দুদক জানিয়েছে, পাথর লুটপাটে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও কিছু স্থানীয় বাসিন্দার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের দায় সবচেয়ে বেশি এবং পর্যটন খাতের ক্ষতির সঙ্গে প্রশাসনের যোগসাজশ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রভাবশালীদের লাগামহীন লুটপাটে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান সাদাপাথরসহ সিলেটের একাধিক পাথর কোয়ারি প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলন চালায়, যার মধ্যে ছিল মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, ধর্মঘট ইত্যাদি। এই দাবির আড়ালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ‘পাথরখেকো চক্র’ প্রকাশ্যে ও গোপনে সাদাপাথরের পাথর লুট করে নিয়ে যায়।
এর মধ্যে সাদাপাথর থেকে পাথর লুটপাটে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সব দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে।