বরেন্দ্র জেলা নওগাঁ। এ জেলা ধানের জন্য বিখ্যাত হলেও বর্তমানে এটি আমের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। জেলায় ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জন করছেন চাষিরা। রোগ বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে লাভবান হচ্ছেন জেলার শত শত চাষি।
জানা যায়, সাধারণত গৌরমতি, আমরুপালি, বারি-৪ ও ব্যানানা ম্যাংগোতে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। এতে কীটনাশক ব্যবহারের দরকার পড়ে না। প্রাকৃতিক উপায়ে রোগমুক্ত এ আমের চাহিদাও তাই বেশি। এ বিশেষত্বের কারণে এখানকার আম বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক আম চাষিরা।
নওগাঁর পোরশা উপজেলার বন্ধুপাড়া এলাকার আম বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে ঝুলছে ব্যাগ। আর তার মধ্যেই সুরক্ষিত পরিপুষ্ট আকর্ষণীয় গৌরমতি, আম রুপালি, বারি-৪ ও ব্যানানা ম্যাংগো জাতের আম। এই আমের চাহিদা রয়েছে দেশসহ বিদেশে। কীটনাশক না দিয়ে পরিবেশসম্মতভাবে আম চাষ করার এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি।
ফ্রুট ব্যাগিংয়ের পাশাপাশি আমের ব্র্যান্ডিং ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে। এটি হলো কোনো পণ্যকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়, নাম এবং গুণগত বৈশিষ্ট্যসহ বাজারজাত করার কৌশল। এর মাধ্যমে পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা গুণগত মানের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ঠিক তেমনিভাবে নওগাঁর আম ব্র্যান্ড বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরা যেতে পারে।
নওগাঁর আম শুধু দেশে নয়, বিগত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ বছর আরও বড় পরিসরে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে চীন সরকারিভাবে আম আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর প্যাকেজিং, উৎসভিত্তিক পরিচয় ও সনদিকরণের অভাবে এই আম বিদেশে গিয়ে হয়ে যায় বাংলাদেশি আম। নওগাঁ নামটি আড়ালে থেকে যায়। নওগাঁ নামটি স্বীকৃতি পায় না। ফলে এর স্থানীয় পরিচয় হারিয়ে যায়। এতে করে সঠিক মূল্যায়ন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে জেলার স্বতন্ত্র ভূমিকা প্রতিফলিত হয় না।
পোরশার সফল আম চাষি রায়হান আলী জানান, চলতি বছর ৬০ বিঘা জমিতে প্রায় ৩ লাখ আমে ফ্রুট ব্যাগিং করেছেন। এসব আম কীটনাশকমুক্ত। আবার পোকামাকড়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও রক্ষা পাবে। ফলন ভালো হবে। বেশিদিন গাছে আম সংরক্ষণ করা যাবে এবং আমের গায়ের রং ভালো ও ঝকঝকে পরিষ্কার থাকবে। এসব আম বিদেশে রপ্তানি করার আশায় তিনি ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ করেছেন। আর এতে বেশ লাভবান হবেন বলে আশা করছেন।
রায়হান আলী বলেন, পোকামাকড় ও বিরূপ আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আম রক্ষা করতে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এছাড়াও ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি আম সংরক্ষণ করার একটি সহজ ও উপযুক্ত পন্থা। যা আমের গুণগত মান ও রং সতেজ রাখতে খুবই কার্যকর।
তার আমবাগানে কর্মরত শ্রমিক শরিফুল ইসলাম, কাদের ও সোলায়মান আলী জানান, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে এই বাগানে কাজ করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালানো হয়। সারা বছর ১৫-২০জন শ্রমিক এই আম বাগানে কাজ করেন। তারা সবাই এই উপার্জন দিয়েই সংসার চালান।
সাপাহারের আমচাষি সোহেল রানা বলেন, নিরাপদ আমে খরচ কিছুটা বেশি হলেও লাভজনক। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম দেরিতে পরিপক্ব হওয়ায় বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। প্রতি বছর সুপার শপে নিরাপদ আমের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এ বছর তিনি ১ লাখ আমে ফ্রুট ব্যাগিং করেছেন বলে জানান।
পত্নীতলার আমচাষি মঞ্জুর এলাহী বলেন, আম রফতানির আগে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। আমে যাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য প্রথমে ফ্রুট ব্যাগিং এর কাগজ দিয়ে প্রতিটি আমের শরীর জড়িয়ে দেয়া হয়। বাগান থেকে আম রফতানির ১৫ দিন আগে থেকে গাছে কীটনাশক স্প্রে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর আম পেড়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মোড়কজাত করা হয়। এতে আম নিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি আমের গায়ের রং সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
পোরশা উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, আধুনিক ও পরিবেশসম্মত আম চাষে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফ্রুট ব্যাগিং মূলত ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে আমকে রক্ষা করে। তাই এতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এতে আমের পচন রোধ হয়। ফলে কৃষক কীটনাশক মুক্ত আম বেশি দামে দেশে ও বিদেশে বিক্রি করে বেশি লাভবান হতে পারেন।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাটি ও জলবায়ুর বিশেষত্বের কারণে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় নওগাঁর আম বেশি সুস্বাদু। যেটাকে নিজেদের ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি হিসেবে নিয়েছেন স্থানীয় চাষিরা। অন্য জেলাগুলোয় যখন আমের মৌসুম শেষের পথে তখনও এখানে প্রচুর আম রুপালি আম পাওয়া যায়। এজন্য প্রতি বছর জেলায় আমের বাগান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
তিনি বলেন, স্বাদে সেরা হওয়ায় দেশীয় সুপার শপে নওগাঁর নিরাপদ আমের কদর বেশি। নিরাপদ আম উৎপাদনে চাষিদের আগ্রহ বাড়াতে রফতনিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পে চাষিদের ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যাগসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। চলতি বছর নওগাঁ জেলায় ৫০ লাখ ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। চলতি বছর জেলায় কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার আম কেনা-বেচা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র: বাসস