সরকার ও অন্যান্য দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণের মাঝে দলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি এবং আস্থা তৈরির জন্য সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহার করে ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে তোলার কৌশল বেছে নিয়েছে বিএনপি।
দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন করে এবং আবারও ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড অনুকরণ করবে না। আর এটি প্রমাণ করতে দলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি ও জনগণের আস্থা অর্জন করাই এখন তাদের লক্ষ্য।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড, বিবৃতি ও দলীয় আচরণের মাধ্যমে দলের সুনাম বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও একমত পোষণ করেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি নিয়ে তাদের আপত্তি-অসন্তোষ সত্ত্বেও গণআন্দোলনের ছাত্রনেতারা এবং কিছু ইসলামী দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানো উচিত। বরং তাদের উচিত কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া।
তিনি বলেন, নির্বাচনি প্রক্রিয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে রাজি করানোর জন্য বিএনপির লক্ষ্য সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
বিএনপি নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে রাজনৈতিক বক্তব্য ও বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে বলেও জানান এই নেতা।
নির্বাচন কমিশন গঠনকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রশ্নে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেও বর্ণনা করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনসহ (ইসি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবে সাড়া দেবেন তারা।
নির্বাচনি ব্যবস্থার সম্ভাব্য সংস্কারের বিষয়ে ইতোমধ্যে বিএনপিসহ ২২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে প্রস্তাব চেয়েছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
বিএনপি ওই নেতা বলেন, ‘মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) রাতে আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের কাছে আমাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি জানান, বিএনপির ৩১ দফা রাষ্ট্রীয় সংস্কার রূপরেখা নিয়ে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মঙ্গলবার ঢাকায় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব বিভাগে একই ধরনের কর্মশালার আয়োজন শুরু হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, তারা গণআন্দোলনের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে জামায়াত ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে একটি সংযোগ গড়ে তুলেছে।
নেতারা বলেন, ‘আমরা জামায়াতের প্রতিও একই মনোভাব গ্রহণ করব। কারণ আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংঘাত চাই না। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আমরা জামায়াতের সঙ্গে সংঘাত চাইছি না।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার এক অনুষ্ঠানে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি ১৭ বছর ধরে নির্যাতন ও হয়রানি সহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত ছাত্ররাই শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো দূরত্ব তৈরি করা চলবে না। এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু বলছে এবং তাদের সেই অধিকার আছে।’
ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে মির্জা ফখরুল ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের সাফল্যকে সুসংহত করতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল ও জাতিকে দুর্বল করার যেকোনো প্রচেষ্টা থেকে রক্ষা পেতে সব অংশীজনের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার ওপর জোর দেন।
রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার বিষয়েও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বলেন, ‘আমরা এটা হতে দিতে পারি না। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কারের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে; যাতে যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা যায়।’
একইসঙ্গে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘নির্বাচনে যেকোনো বিলম্ব বিদ্যমান সমস্যাকে আরও খারাপ করতে পারে এবং স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য অসৎ কাজে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।’
দেশের স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য নিশ্চিত করতে বিএনপির সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুই দলের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো দূরত্ব নেই। তবে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন।’
আগামী নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির জোটে থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনই কিছু বলা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। আমরা নির্বাচনের আগে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেব- এককভাবে নাকি জোটের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্রনেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের পাশাপাশি জনগণকেও তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা বর্তমান সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব।’