রেখা রাণী ওঝা নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করেন। অজপাড়াগাঁয়ের এই নারী ছাত্রী অবস্থায়ই পণ করেন মেয়েদের জন্য একটি স্কুল গড়ে তুলবেন। সেই পণ থেকেই বিয়ে পর্যন্ত করেননি। শেষ জীবনে কোথায় থাকবেন, কী খাবেন সেই চিন্তাও করেননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের নিজ গ্রাম বুরুয়াতে গড়ে তোলেন তার স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নাম দেন ‘কুমারী রেখা রাণী গার্লস হাই স্কুল’। প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। পাঠদানের অনুমতি মিললেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীরা।
শেষ জীবনে এসে হতাশায় ভুগছেন স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ক্যানসারে আক্রান্ত রেখা রাণী ওঝা। মৃত্যুর আগে যেন বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হিসেবে দেখে যেতে পারেন সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
রেখা রাণী ওঝা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সে সময় অজপাড়াগাঁ থেকে কাদাপানি ঝাপিয়ে ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের স্কুলে মেয়েরা লেখাপড়া করতে যেত না, তবে আমার খুব জেদ ছিল লেখাপড়া করার। ষষ্ঠ শ্রেণি পড়া অবস্থায় বাবা চেয়েছিলেন লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে, তখন বাড়ি থেকে রাগ করে স্কুল সংলগ্ন বান্ধবীর বাসায় গিয়ে উঠি। ১৯৬৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী শিবিরে চলে যাই। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করি।
‘১৯৭২ সালে কলাবাড়ি ইউনিয়নের হিজলবাড়ি বিনয় কৃষ্ণ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এসএসসি পাসের পর উপজেলাতে কলেজ না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। বাবা দূরে কোথাও ভর্তি করতে নারাজ। বাবার সঙ্গে রাগ করে চলে যাই সবুজ অপেরা যাত্রা দলে। দুই বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিনয় করি সবুজ ও নবযুগ অপেরার যাত্রাপালাতে। ১৯৭৫ সালে ফিরে আসি গ্রামে। চালু করি পাঠশালা। একটা মেয়ে পাঠশালা চালাবে তা ভালো চোখে দেখত না গ্রামের অনেকেই। এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় ১৯৭৭ সালে নার্সিংয়ে ভর্তি হই। সেখানে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় ২ বছর বন্ধ থাকে লেখাপড়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৮২ সালে নার্সিং পাস করে ১৯৮৩ সালে চাকরিতে যোগ দিই। শুরু হয় আমার সংগ্রামী জীবন। চাকরি জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতে থাকি। চাকরিরত অবস্থায় ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে টাঙ্গাইল তিতুমীর কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করি। ২০১৪ সালে অবসরে এসে সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কলাবাড়ি ইউনিয়নের বুরুয়া গ্রামে মাত্র ৪৭ জন ছাত্রী নিয়ে কুমারী রেখা রাণী গার্লস হাই স্কুল নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। ২০১৮ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পাঠদানের অনুমতি পায়।’
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৩০ জন ছাত্রী ও ১১ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এমপিও না হওয়ার কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানিয়েছেন রেখা রাণী ওঝা।
রেখা রাণী ওঝা আক্ষেপ করে বলেন, ‘মেধাবী ছাত্রী হয়েও অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে বলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই নার্সিং পড়ার সময় প্রতিজ্ঞা করে ছিলাম যে, জীবনে যেভাবেই হোক এলাকার নারীদের শিক্ষালাভের জন্য আমি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব। তাই আমি আমার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ দিয়ে শেষ জীবনে এসে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি। শেষ জীবনে আমি কী খাব, কোথায় থাকব সে চিন্তা করিনি।
‘২০১৮ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পাঠদানের অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি। এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই আমি দ্রুত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সমাপ্তি হালদার বলে, ‘আমাদের এলাকার কাছাকাছি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাই। এই প্রতিষ্ঠানটি হওয়ার পরে আমরা এখানে লেখাপড়া করছি। এখানে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি না হলে হয়তোবা আমাদের লেখাপড়া করা হত না। কষ্ট করে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করায় আমরা রেখা রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রী মুক্তা সরকার বলে, ‘এই বিদ্যালয়ে আমরা যারা লেখাপড়া করি তাদের এখানে শিক্ষাগ্রহণে কোনো প্রকার টাকা পয়সা দিতে হয় না। রেখা রাণীই আমাদের লেখাপড়ার খরচ জোগায়। তিনি আমাদের সন্তানের মতো ভালোবাসেন।’
কুমারী রেখা রাণী গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় বাড়ৈ বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী ছিল। এখন ৮ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী রয়েছে। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে দিন দিন শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো সম্ভব হবে না।’
কলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজন বিশ্বাস বলেন, ‘রেখা রাণী একজন সর্বত্যাগী মানুষ। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। তার কোনো বাড়িঘর নাই। বিদ্যালয়টির একটি ছোট কক্ষে তিনি বসবাস করেন। এখানের ছাত্রীদের নিয়েই তার দিন কাটে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের তিনি তার সন্তানের মতো ভালোবাসেন। রেখা রাণীর স্বপ্ন তার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নারী শিক্ষায় দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে। তাই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করার মাধ্যমে রেখা রাণীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
কোটালীপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নুর আলম সিদ্দিক বলেন, ‘রেখা রাণীর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তার এই বিদ্যালয়টি দ্রুত সময়ের মধ্যে এমপিওভুক্ত করতে হলে এলাকার জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিম উদ্দিন বলেন, ‘বিদ্যালয়টিতে আমি ঘুরে এসেছি। রেখা রাণী নিজ উদ্যোগে স্কুলটিকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। সরকারিভাবে যাতে সব সুযোগ-সুবিধা পায় সেজন্য ইতিবাচক প্রতিবেদন দেব।’