রাজধানীর প্রগতি সরণিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনের সড়কে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী।
ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে রাজধানীর সদরঘাট থেকে গাজীপুর রুটে সুপ্রভাত পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরিবহন বন্ধ হলেও বাসগুলো বসে থাকেনি। রঙ ও পরিবহনের নাম পাল্টে সেগুলো সচল থাকে রাস্তায়। গাড়ির চালক-সহকারীও বদল হয়নি।
সবার চোখ ফাঁকি দিতে বাসগুলো ঢুকে যায় ভিক্টর ক্ল্যাসিক, আকাশ, সম্রাট, ট্রান্সলাইন নামের পরিবহনগুলোতে। গণমাধ্যমে এই বিষয়ে তখন বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি। নেয়া হয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও।
বাসগুলোর চালক-সহকারীরাও সংশোধন হয়নি। বাসের নাম পরিবর্তন করা হলেও সেই রেষারেষি, যত্রতত্র যাত্রী নামানো-উঠানো, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার রয়েই গেছে। চালকদের বেপরোয়া আচরণের কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি।
বাস মালিক সমিতির বক্তব্যও দায়সারা। তারা বলছেন, কিভাবে ব্যানার পরিবর্তন করে আরেক পরিবহনে বাসগুলো ঢুকে পড়েছে সে বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
সবশেষ রোববার প্রগতি সরণিতে যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাস মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে দুজন ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় ওই বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাণ নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা বাসটি আটক করতে সক্ষম হলেও পালিয়ে যান ওই ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চালক লিটন ও সহকারী আবুল খায়ের। পুলিশ সোমবার তাদের গ্রেপ্তার করে। পরে আদালত তাদেরকে দুইদিনের রিমান্ডে পাঠায়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোমবার দুপুরে রাজধানীর প্রগতি সরণির কাওলা মোড়ে প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় নাদিয়ার নামে বাস স্টপেজ, রাস্তায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ করাসহ চারটি দাবি জানান তারা।
শিক্ষার্থীদের দাবি মানা হলে ভিক্টর ক্লাসিকের বাস চলাচল বন্ধ হবে। প্রশ্ন উঠেছে, এবারও সুপ্রভাত পরিবহনের মতোই কেবল পরিবহনের নাম ও বাসের রঙ পরিবর্তন হবে? বাস্তবে বাসগুলোর চালক ও সহকারীরা কোনো জবাবদিহির আওতায় আসবে নাকি অতীতের মতোই দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা চলবে?
এসব আশঙ্কাই সত্যি হবে বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের গাড়িগুলো গ্যারেজে গিয়ে তাতে নতুন রঙ চড়ানো হবে। এরপর লাগিয়ে দেয়া হবে নতুন কোনো পরিবহনের ব্যানার।
‘আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী নিয়ম-কানুন না মেনে যদি বাস চলে তাহলে শুধু বাসের ব্যানারই পরিবর্তন হবে। আর কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। আর যেহেতু বাসগুলোর চালকের আসনে বেপরোয়া মানসিকতার আনাড়ি লোকই থাকবে, তাই দুর্ঘটনার নামে প্রাণহানিও বন্ধ হবে না।’
ভিক্টর পরিবহনের বাসের চাপায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিয়া হত্যার প্রতিবাদে সোমবার সড়কে নামেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণের নিয়ম হচ্ছে দৈনিক যে আয় হবে তা থেকে সব খরচ বাদে মালিক ১০ শতাংশ মুনাফা পাবেন। কিন্তু আয় কী হলো না হলো তা দেখেন না বাস মালিকরা। চালককে দৈনিক মালিককে তিন থেকে চার হাজার টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘চালক যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন তখন তার মাথায় থাকে মালিকের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সব খরচ বাদে তাকে আয় করতে হবে। এটাই নৈরাজ্যের মূল। অর্থাৎ আইন না মেনে উল্টো নিয়মে চলছে নগর পরিবহন খাত। এই উল্টো নিয়মে চলার কারণেই বাস পরিবহনে নৈরাজ্য চলছে, চলবে।
‘সড়ক পরিবহন আইন মানতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানানো যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত যে ব্যানারেই গাড়ি চলুক অনিয়ম-অপরাধ কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমানও স্বীকার করেন যে সড়ক পরিবহনে অনিয়ম হচ্ছে। একইসঙ্গে তিনি জানান, এই অনিয়ম রোধে সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সড়ক পরিবহনে আমরাও অনেক অনিয়ম পেয়েছি। সড়কে নৈরাজ্য ঠেকাতে আমরা ই-টিকেটিং পদ্ধতি এনেছি। ই-টিকেটিং চালুর পর আমরা ভাড়ার নৈরাজ্য কিছুটা কমে এসেছে। অন্যান্য সমস্যা নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
ই-টিকেটিং-এর আওতায় কয়েকটি রুটের বাস মালিকের কাছ থেকে চালকরা চুক্তিতে নিয়ে বাস চালাচ্ছে। তবে নগর পরিবহনের প্রায় সব রুটেই অনিয়ম-নৈরাজ্যের বরাবরের চিত্র রয়ে গেছে। ফলে ই-টিকেটিং থাকলেও তা সেভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ‘চুক্তিতে যাতে কেউ বাস চালাতে না পারে সে ব্যবস্থা আমরা নেব। কোনো গাড়ি চুক্তিতে চলতে পারবে না। কারণ এটা বন্ধ না হলে সড়কে গাড়ি চালানো নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতাটা রয়েই যাবে।’
কোনো ঝামেলা হলেই সংশ্লিষ্ট পরিবহনের বাস আরেক ব্যানারে সড়কে নামছে। এটা রোধে কোনো উদ্যোগ আছে কী না- এমন প্রশ্নে মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যানার পরিবর্তনের বিষয়ে ওনারা (ব্যানার ও বাস মালিক) বলতে পারবেন। কিভাবে তারা ব্যানার পরিবর্তন করেন সেটা আমরা অবহিত নই।’
বাসের ব্যানার পরিবর্তনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মোবাইল ফোনে একাধিক বার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বিষয়টির উল্লেখ করে এসএমএস পাঠিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।