বিএনপির নিখোঁজ এক নেতার বাসায় যাওয়ার পর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে ঘিরে যে ঘটনাপ্রবাহ হয়েছে, তাতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসার যে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, সেটিরও কোনো শঙ্কা নেই বলে মনে করেন তিনি।
মঙ্গলবার রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস)-এ এক আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ কোনো চাপে নেই।’
আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর ১৬টি বৈঠক হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। আমাদের সম্পর্ক ভালো বলেই তারা আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকে। এটি ভালো। আমাদের আতঙ্কের কারণ নাই, আশঙ্কারও কারণ নেই।’
বাংলাদেশ সফরে ১০ ডিসেম্বরের আগে আমেরিকা যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে, সে বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি তাদের দায়িত্ব। যদি তাদের লোক এখানে আসে এবং আহত হয়, তাহলে দূতাবাসের দায়িত্ব নিতে হয় না। এটি ভুল নয়।
‘আর বিষয়টি আপনারা বরং তাদেরই জিজ্ঞাসা করেন। আপনি (সাংবাদিক) কি দেশে কোন আতঙ্ক দেখেন? তাহলে আপনি এটা নিয়ে এত আতঙ্কিত কেন?’
পিটার হাসের সঙ্গে কী হয়েছে
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পিটার হাস যান বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায়।
২০১৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে নিখোঁজ সুমনের বোন গড়ে তুলেছেন মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠন। গত কয়েক বছরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বজনদের নিয়ে এই সংগঠনটি সরকারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ এনে নানা কর্মসূচি পালন করছে।
পিটার হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর কী নিয়ে কথা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো পক্ষ কিছু জানায়নি। তবে তিনি সেখানে যাওয়ার পর যা হয়, সেটি গত কয়েক দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্র।
- আরও পড়ুন: নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত
- আরও পড়ুন: জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে হাসের কাছে স্মারকলিপি
- আরও পড়ুন: ‘মায়ের কান্না’য় বিব্রত হাস, মোমেনের কাছে অনুযোগ
সুমনের বাসায় হাস যাওয়ার পর সেখানে যান ‘মায়ের কান্না’ নামে আরও একটি সংগঠনের সদস্যরা। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেনা ও বিমান বাহিনীতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। তারা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন।
পিটার ডি হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর সেখানে হাজির হন মায়ের কান্না নামের সংগঠনের সদস্যরা। তারা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে। ফাইল ছবি
পিটার হাসকে এই সংগঠনের সদস্যরা একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক তদন্ত চাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের প্রটোকল অফিসাররা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেননি। তারা হাসকে নিয়ে দ্রুত ত্যাগ করেন ঘটনাস্থল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দূত সোজা চলে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
মোমেন তখন তার কাছে জানতে চান, কোনো হামলা হয়েছে কি না। ‘না’ জবাব আসার পর তিনি প্রস্তাব দেন নিরাপত্তা বাড়াতে। তবে এটি জানিয়ে দেন, কোনো সংগঠনের কর্মসূচি তারা আটকাতে পারেন না।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সেদিন হাসের পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক সংগঠন, নাগরিক সমাজের বিবৃতিও আসে, তাতে অভিযোগ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখাচ্ছেন।
- আরও পড়ুন: খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত আমেরিকা: প্রধানমন্ত্রী
- আরও পড়ুন: সুমনের বাড়ি গেছেন, আমেরিকায় মাসে কত গুম: হাসকে কাদের
- আরও পড়ুন: পিটার হাসের কাছে ‘আরও সুবিবেচনা’ প্রত্যাশা তথ্যমন্ত্রীর
অন্যদিকে বিএনপি আছে পিটার হাসের পাশেই। তারা মনে করে এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে। সরকার এখন বিদেশিদেরও ভয় দেখাচ্ছে, এমন বক্তব্যও এসেছে দলটির পক্ষ থেকে।
- আরও পড়ুন: পিটার হাসের পাশে বিএনপি, হেনস্তার অভিযোগ
এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেখিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ঘটনার পরের দিনই ওয়াশিংটনে ঢাকার রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। সেই বৈঠকে পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান দেশটির কর্মকর্তা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ডোনাল্ড লুকে ঢাকার অবস্থান ও ওই দিনের ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। রাষ্ট্রদূত জানান, পিটার হাস চাইলে ঢাকায় তাকে অধিকতর নিরাপত্তা দেয়া হবে।
‘নতুন নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা নেই’
মোমেন কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জন নিয়েও। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞার কোনো শঙ্কা নেই। ধনী দেশগুলো প্রায়শই নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকা যাদের ওপর চাপ দিতে চায় তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। মনে আছে না, মোদির (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলো, আবার উঠিয়ে নিল।
‘তারা অনেক নিষেধাজ্ঞা দেয়। বড়লোকেরা অনেক নিষেধাজ্ঞা দেয়। এগুলো একদিকে আসে, অন্যদিকে চলে যায়। আমরা এগুলো নিয়ে মোটেই আতঙ্কিত নই।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র্যাব এবং বাহিনীটির কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। যাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন বিদায়ী পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদও।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগে দলটির কর্মী-সমর্থকরা আরও একটি নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে প্রচার করতে থাকেন। সমাবেশের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে আসা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে আরও একটি নিষেধাজ্ঞা আসার বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন একজন সাংবাদিক।
জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের ব্যর্থতা ও অপকর্মের জন্য র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আবার যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে সেটার জন্যও দায়ী থাকবে সরকার।
মানবাধিকার প্রসঙ্গ
মন্ত্রী কথা বলেন ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা নিয়েও। এ বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যারা মানবাধিকারে বিশ্বাসী নয়, তাদের মুখে মানবাধিকারের বুলি হাস্যকর, ভাঁওতাবাজি।’
বিএনপি শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে মোমেন বলেন, ‘যারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তারা কীভাবে মানবাধিকারের কথা বলে? ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। এমনকি আদালতের জজ সাহেবও শান্তিতে থাকতে পারেননি।
‘বিদেশি রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা হয় এবং ৬৩ জেলায় বোমাবাজি হয়। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা একটি র্যালি করেন নিজের অফিসের সামনে। সেই র্যালিতে গ্রেনেড হামলা হয়, ২৪ জন মারা যায় এবং অনেকে জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।’
মোমেন বলেন, ‘তাদের (বিএনপি) আগে সামাল দেয়া দরকার। এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তারা নাকি এখন সব ঠিক করে দেবেন। এটি হাস্যকর।’