ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিএনপির নিখোঁজ নেতার বাসভবনে যাওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতির পর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে আমেরিকার সরকার।
বিষয়টি নিশ্চিত করলেও একে তলব বলতে চায় না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের দাবি এটি নিয়মিত বৈঠক।
১৪ ডিসেম্বর ঢাকার শাহীনবাগের ঘটনায় পরদিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে ডেকে ঢাকায় কী হয়েছে, তা জানতে চায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই বিষয়টি রোববার জানাজানি হয় বাংলাদেশে।
গত বুধবার ঢাকার শাহীনবাগে বিএনপির নিঁখোজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যান পিটার হাস। সুমনের বোন গড়ে তুলেছেন মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠন। গত কয়েক বছরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বজনদের নিয়ে এই সংগঠনটি সরকারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ এনে নানা কর্মসূচি পালন করছে।
পিটার হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর কী নিয়ে কথা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো পক্ষ কিছু জানায়নি। তবে তিনি সেখানে যাওয়ার যা হয়, সেটি গত কয়েক দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্র।
- আরও পড়ুন: নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত
- আরও পড়ুন: জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে হাসের কাছে স্মারকলিপি
- আরও পড়ুন: ‘মায়ের কান্না’য় বিব্রত হাস, মোমেনের কাছে অনুযোগ
সুমনের বাসায় হাস যাওয়ার পর সেখানে যায় ‘মায়ের কান্না’ নামে আরও একটি সংগঠনের সদস্যরা। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেনা ও বিমান বাহিনীতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। তারা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন।
পিটার ডি হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর সেখানে হাজির হন মায়ের কান্না নামের সংগঠনের সদস্যরা। তারা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে। ফাইল ছবি
পিটার হাসকে এই সংগঠনের সদস্যরা একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক তদন্ত চাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের প্রটোকল অফিসাররা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেননি। তারা হাসকে নিয়ে দ্রুত ত্যাগ করেন ঘটনাস্থল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দূত সোজা চলে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
মোমেন তখন তার কাছে জানতে চান, কোনো হামলা হয়েছে কি না। ‘না’ জবাব আসার পর তিনি প্রস্তাব দেন নিরাপত্তা বাড়াতে। তবে এটি জানিয়ে দেন, কোনো সংগঠনের কর্মসূচি তারা আটকাতে পারেন না।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সেদিন হাসের পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক সংগঠন, নাগরিক সমাজের বিবৃতিও আসে, তাতে অভিযোগ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখাচ্ছেন।
- আরও পড়ুন: খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত আমেরিকা: প্রধানমন্ত্রী
- আরও পড়ুন: সুমনের বাড়ি গেছেন, আমেরিকায় মাসে কত গুম: হাসকে কাদের
- আরও পড়ুন: পিটার হাসের কাছে ‘আরও সুবিবেচনা’ প্রত্যাশা তথ্যমন্ত্রীর
অন্যদিকে বিএনপি আছে পিটার হাসের পাশেই। তারা মনে করে এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে। সরকার এখন বিদেশিদেরও ভয় দেখাচ্ছে, এমন বক্তব্যও এসেছে দলটির পক্ষ থেকে।
- আরও পড়ুন: পিটার হাসের পাশে বিএনপি, হেনস্তার অভিযোগ
- আরও পড়ুন: কূটনীতিকদের ভয় দেখাচ্ছে সরকার: হাসের ঘটনায় খসরু
তবে এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেখিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ঘটনার পরের দিনই ওয়াশিংটনে ঢাকার রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। সেই বৈঠকে পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান দেশটির কর্মকর্তা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ডোনাল্ড লুকে ঢাকার অবস্থান ও ওই দিনের ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। রাষ্ট্রদূত জানান, পিটার হাস চাইলে ঢাকায় তাকে অধিকতর নিরাপত্তা দেয়া হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা নিয়মিত বৈঠক। ওনারা (যুক্তরাষ্ট্র) তলব করেন নাই। আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানে আগে থেকেই আলাপ করার জন্য চেষ্টা করছিলেন। এরপর তারা সাক্ষাৎসূচি (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) দিয়েছে। আমরা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছি তাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। এটি নিয়মিত বৈঠক।’
তবে নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সাধারণত সব পুনর্নির্ধারিত বৈঠকের প্রতিদিনের সাক্ষাৎ ও কাজের সূচি তুলে ধরা হয়। ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি তাদের সাক্ষাৎসূচিতে নেই।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে নিয়ে ঘটনায় নিরাপত্তা উদ্বেগের কিছু নেই এবং এ ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে এ ঘটনা প্রভাব ফেলবে না।
সেদিন পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘এ ঘটনায় নিরাপত্তা উদ্বেগের কিছু নেই। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।
‘দুই দেশের সম্পর্ক তো অনেক দিনের পুরোনো। বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বয়স প্রায় ৫০ বছরের কোঠায়। সুতরাং একটা ঘটনা বা এ ধরনের একটা আচরণে সেই সম্পর্ক নষ্ট হবে, বিষয়টা এমন নয়। ওই রকম কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখি না।’