বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে কারণে কিশোরগঞ্জে বিজয় আসে এক দিন পর

  •    
  • ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ১০:১৬

পাকিস্তানি বাহিনী ৪ ডিসেম্বর চলে গেলেও শহীদী মসজিদ ও জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা আতাহার আলী ও হয়বতনগর আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান সৈয়দ মুসলেহউদ্দিনের অনুসারী হাজার হাজার রাজাকার কিশোরগঞ্জ শহর ছাড়তে রাজি হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের দল শহরের উপকণ্ঠে হাজির হলে ভীত হয়ে অনুকম্পা চায় তারা। পরদিন সকালে জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসায় আত্মসমর্পণ করে।

১৯৭১ সালে সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল, তখনও মুক্তির স্বাদ পায়নি যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জ। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় জেলাটি।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয়, দখল ছাড়ছিল না তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা যাবে না, এমনটি বুঝতে পেরে তারা হাল ছেড়ে দেয় ৪ ডিসেম্বরই। কিশোরগঞ্জ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় সেদিন, কিন্তু তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা চেষ্টা চালিয়ে যায়।

কিশোরগঞ্জ ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এর নেতৃত্বে ছিলেন নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান আতাহার আলী, আতাউর রহমান খান, জামায়াতে ইসলামীর মাহতাব উদ্দিন ও মফিজ উদ্দিনের মতো নেতারা।

রাজাকারদের হটাতে ১৬ ডিসেম্বর কোম্পানি কমান্ডার কবীর উদ্দিন আহমেদ, সাব্বির আহমেদ মানিক, হান্নান মোল্লা, আবদুল আলী মাস্টার ও আনোয়ার কামালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ভাগ হয়ে শহর ঘেরাও করেন।

কবীর উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অবস্থা বেগতিক দেখে রাজাকাররা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠালে ১৭ ডিসেম্বর সকালে শহরে প্রবেশ করি আমরা।’

কিশোরগঞ্জ মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি জানান, ১৪ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ থেকে ৯০ জনের একটি দল নিয়ে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে তাড়াইল দিয়ে করিমগঞ্জে প্রবেশ করেন তিনি। সারা দিন তারা করিমগঞ্জেই অবস্থান করেন।

সেখানে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার গাজী মান্নানের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের নির্যাতন করে বলে জানতে পারেন।

কবীর উদ্দিন ১৫ ডিসেম্বর করিমগঞ্জের নিয়ামতপুরের নিজ বাড়িতে রাতে অবস্থান করে পরের দিন সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যান করিমগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ কথা শুনে রাজাকাররা পালিয়ে যায়।

তখন মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান, রাজাকাররা কিশোরগঞ্জ শহরকে ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে। এরপর শহর মুক্ত করতে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রওনা দেন তারা।

তাদের দলটি করিমগঞ্জের জাফরাবাদে এলে আইনজীবী ফজলুল কবীরের সঙ্গে একটি জিপে করে কিশোরগঞ্জ সদরের বৌলাই আসেন কবীর উদ্দিন। বৌলাই থেকে যান শহরের কাছের এলাকা সতালে।

মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছেন জেনে ভীত হয়ে যায় রাজাকাররা। জিয়া উদ্দিন নামে একজনের মাধ্যমে পাঠানো হয় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব।

রক্তক্ষয় ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানির কথা বিবেচনা করে প্রস্তাব মেনে নেন তারা। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সকালে কিশোরগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

শহরের রেললাইনের কাছে এলে সাধারণ মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানায়। পরে শহরের ইসলামিয়া ছাত্রাবাসের সামনে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এর আগেই অনেক রাজাকার পালিয়ে যায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সাব্বির আহমেদ মানিক নিউজবাংলাকে বলেন, “আমরা ‘হয় মরব, না হয় মারব’ প্রতিজ্ঞা নিয়েই যুদ্ধে যাই। আমরা বেঁচে ফিরব, সে চিন্তা করিনি।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা নোয়ার কামাল বলেন, ‘রাজাকার-আলবদর বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর মুহূর্তেই বদলে যায় শহরের চিত্র। যেদিকেই তাকাই দেখি কেবল আনন্দ মিছিল আর আনন্দ মিছিল। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।’

যে কারণে এক দিন পরে মুক্ত হয় কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন কবি ও লোকজ সংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তিনি জানান, এ শহরের প্রধান মসজিদ ‘শহীদী মসজিদ’ এবং প্রধান মাদ্রাসা ‘জামিয়া ইমদাদিয়া’। এই মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মাওলানা আতাহার আলী। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী সব মিলিয়ে অগণিত অনুসারী ছিল তার। মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামীর আমির ছিলেন তিনি।

অন্যদিকে শহরের ‘হয়বতনগর আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান ছিলেন সৈয়দ মুসলেহউদ্দিন। তিনি পাকিস্তানপন্থি নেতা। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর (নান্দাইলের বাসিন্দা) নূরুল আমিনের দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিডিপি) সিনিয়র সহসভাপতি। তারও অজস্র অনুসারী ছিল।

‘ধর্মীয় নেতা হিসেবে মাওলানা আতাহার আলী ও সৈয়দ মুসলেহউদ্দিনের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই এরা পাকিস্তান রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাওলানা মুসলেহউদ্দিন মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন।’

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই দুই মাওলানার হাজার হাজার অনুসারী রাজাকার ও আল শামস বাহিনীতে যোগ দেয়, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখনও বেশি ছিল না। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনারা জেলা ছেড়ে চলে গেলেও এসব রাজাকার প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে, যা ভেদ করে জেলা সদরকে মুক্ত করা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ছিল কঠিন ও দুঃসাধ্য।’

তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন দল আসার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এরপর সমঝোতার ভিত্তিতে এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ মুক্ত হয়।

এই লেখক বলেন, ‘আজও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি অনেক বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী। সে তুলনায় আমরা কথিত স্বাধীনতার চেতনাধারীরা ব্যক্তিস্বার্থে বহুধাবিভক্ত, যা ওদের শক্তিকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।

‘এখনও সময় আছে, সব বিভেদ-বিভ্রান্তি ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী খাঁটি মানুষদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। নইলে প্রজন্ম আরও বেশি বিভ্রান্ত হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর