ইরান ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছে তেহরান। এর পাশাপাশি একাধিক অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেছে ইরান সরকার।
ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইসরায়েলি এজেন্টদের অনুপ্রবেশের পর এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা।
ইরান সরকারের অভিযোগ, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডার ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে হত্যাসহ যুদ্ধ চলাকালীন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের কাছে সরবরাহ করা তথ্যই ভূমিকা রেখেছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দায়ী করেছে তেহরান। তারা ইরানের ভেতর থেকেই এসব পরিচালনা করেছে বলে দাবি দেশটির।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপকতা ও নিখুঁত বাস্তবায়নে হতবাক ইরানি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এখন যেকোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে ইরান।
তবে এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে ভিন্নমত দমন ও জনগণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনব্যাপী সংঘাতের সময় তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান সরকার। যুদ্ধবিরতির পরদিন ২৫ জুন এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরপর থেকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে—এমন শত শত সন্দেহভাজনের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমনকি আটক কয়েকজনের বক্তব্যও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। সেখানে তাদের ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করার কথা স্বীকার করতে দেখা যায়।
এদিকে, চলমান এই অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলো।
তারা বলেন, ইরানের বিচারব্যবস্থায় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি গ্রহণ ও অন্যায্য বিচারের ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া, আরও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
অন্যদিকে, ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিআইএ, মোসাদ ও এমআই৬-এর মতো পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ‘নিরলস লড়াই’ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
আইআরজিসি সঙ্গে সম্পৃক্ত ফার্স নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুসারে, ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ইরানেরর ভেতরে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সংঘাতের ১২ দিনে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত সাত শতাধিক ব্যক্তিকে ইরানি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলেও দাবি করেছে তারা।
বিবিসি ফারসিকে ইরানের কয়েকজন নাগরিক জানিয়েছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে হুঁশিয়ারিমূলক বার্তা পেয়েছেন। সেখানে তাদের ফোন নম্বর ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া পেজে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের এসব পেজ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, না হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি ফারসি, লন্ডনভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল ও মানোতো টিভিসহ দেশের বাইরের ফারসি ভাষার গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ওপরও ইরান সরকার চাপ বাড়িয়েছে বলে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ, সম্প্রতি তাদের একজন নারী উপস্থাপিকার মা, বাবা ও ভাইকে তেহরানে আটক করেছে আইআরজিসি। চ্যানেল থেকে ওই উপস্থাপিকাকে পদত্যাগ করার জন্য তার বাবাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আহ্বান জানানো হয়। এমনকি পদত্যাগ না করলে আরও কঠোর পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়।
যুদ্ধ শুরুর পর বিবিসি ফারসির সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের প্রতি হুমকি আরও বেড়ে গেছে বলে দাবি করেছে সংবাদ মাধ্যমটি।
ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধাবস্থায় পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করাও ন্যায্য—এমন হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সাংবাদিক।
এসব সাংবাদিককে ‘মোহারেব’ বা ‘আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে’ এমন ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে যা ইরানি আইনে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
সাংবাদিকদের পরিবারের প্রতি হুমকি এবং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করার প্রচেষ্টার মতো ঘটনার কথা জানিয়েছে মানোতো টিভিও।
এসব পদক্ষেপ মূলত ভিন্নমত দমন ও নির্বাসিত সংবাদকর্মীদের ভয় দেখানোর একটি বৃহৎ কৌশলের অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বহু অধিকারকর্মী, লেখক ও শিল্পীকেও আটক করেছে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই তাদের করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি ২০২২ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যদেরও আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল বর্তমান আন্দোলন নয়, আগের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেয় এসব পদক্ষেপ।
যুদ্ধ চলাকালে সরকার ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। যুদ্ধবিরতির পরও পূর্ণ প্রবেশাধিকার এখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।
দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ এখন ইরানের একটি সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরানে ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, এক্স ও ইউটিউবসহ অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এবং বিবিসি ফারসিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ। সেগুলো কেবল ভিপিএন বা প্রক্সি সার্ভিস ব্যবহার করেই দেখা যায়।
এসব ঘটনায় আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমানের এসব পদক্ষেপের মিল খুঁজে পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার-কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সে সময় রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেছিল ইরান সরকার।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে দুর্বল হয়ে পড়া ইরান হয়তো আবার দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক গ্রেপ্তার, মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে কঠোর দমন-পীড়নের পথে হাঁটছে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ইরানের এসব কর্মকাণ্ডের সমালোচকরা ১৯৮৮ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, সে সময় সংক্ষিপ্ত ও গোপন বিচার শেষে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল আগেই সাজাপ্রাপ্ত। ওই সময়ে অধিকাংশকে পরিচয়হীন গণকবরে দাফন করা হয়েছিল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছিল।