ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে সরকার ভয় দেখিয়েছে বলে মনে করেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, সরকার আগে দেশের মানুষকে ভয়ে রাখত, তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার জন্য এখন বিদেশি কূটনীতিকদের ভয়ের মধ্যে রাখার জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে।‘
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পিটার হাস বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যাওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিএনপির পক্ষ থেকে দলের অবস্থান তুলে ধরতে দুপুরের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স।
সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিয়ষটি নিয়ে কথা বলেন আমীর খসরু মাহমুদও। তিনি বলেন, ‘সরকারের পরোক্ষ মদতে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই ফুটে উঠেছে। আর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
- আরও পড়ুন: পিটার হাসের পাশে বিএনপি, হেনস্তার অভিযোগ
রাষ্ট্রদূত সরকারকে না জানিয়ে সুমনের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে যে বক্তব্য আসছে সে বিষয়ে খসরু বলেন, ‘তাহলে দুই দিন আগে থেকে পুলিশ যে ঘুরে গেল সেটা কীভাবে হলো সরকার যদি না জানে?’
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে হঠাৎ করেই রাজধানীর শাহীনবাগে সুমনের বাসায় যান পিটার হাস। সেখানে অবস্থান করেন ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। তবে তিনি বা বিএনপি নেতার পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
২০১৩ সালে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বুধবার সেখানে তার যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সরকার।
সুমনের বাড়িতে যাওয়ার পর সেখানে যান ‘মায়ের কান্না’ নামের আরেক সংগঠনের সদস্যরা। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেনা ও বিমান বাহিনীতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। তারা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন।
পিটার হাসকে এই সংগঠনের সদস্যরা একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের প্রটোকল অফিসাররা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তারা হাসকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
- আরও পড়ুন: নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত
- আরও পড়ুন: জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে হাসের কাছে স্মারকলিপি
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দূত সোজা চলে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান তিনি।
পিটার ডি হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর সেখানে হাজির হয় মায়ের কান্না নামে সংগঠনের সদস্যরা। তারা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে।
মোমেন তখন তার কাছে জানতে চান, কোনো হামলা হয়েছে কি না। ‘না’ জবাব আসার পর তিনি প্রস্তাব দেন নিরাপত্তা বাড়াতে। তবে এটি জানিয়ে দেন, কোনো সংগঠনের কর্মসূচি তারা আটকাতে পারেন না।
হাসের এই পদক্ষেপে সরকার যে অসন্তুষ্ট তা গোপন করার চেষ্টা হয়নি এতটুকু।
সেদিনই বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমেরিকা খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত।’
একই আলোচনায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পিটার হাসকে উদ্দেশ করে জানতে চান- আমেরিকায় মাসে কত গুম, খুন ও ধর্ষণ হয়।
- আরও পড়ুন: খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত আমেরিকা: প্রধানমন্ত্রী
- আরও পড়ুন: সুমনের বাড়ি গেছেন, আমেরিকায় মাসে কত গুম: হাসকে কাদের
পরদিন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, তিনি মনে করেন, হাসের সেই বাড়িতে যাওয়া উচিত হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি না তাকে কে পরামর্শ দিয়েছে সেই দিনে মায়ের ডাক নামের সংগঠনের কো-অর্ডিনেটরের বাসায় যেতে। যারাই এ পরামর্শ দিয়েছে, তারা সঠিক পরামর্শ দেয়নি। আমি মনে করি, যেই পরামর্শ দিক, সিদ্ধান্ত তো নিজের। কাজেই ওনারও আসলে দিবসের দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার ছিল।’
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএনপি নেতা এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘পিটার হাসের সঙ্গে রাজধানীর শাহীনবাগে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা দুঃখজনক। আওয়ামী দুঃশাসনের কবল থেকে শুধু দেশের জনগণ নয়, বিদেশিরাও নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গাড়িতে হামলা তারই প্রমাণ। আওয়ামী লীগের নির্দেশেই এটি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’
পরে আমীর খসরু বলেন, ‘এর আগেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল তার বিচার হয়নি। এবার মায়ের কান্না নামে যে সংগঠনটি আরেকটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বাধাগ্রস্ত করে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, এটা আইনবিরোধী। এর আগেও তারা আমাদের মানবাধিকার-বিষয়ক একটা অনুষ্ঠান চলাকালে সেটা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। সরকার পরোক্ষভাবে এই ঘটনা ঘটেছে।’
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় যান সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট।
এরপর বাসভবনটি ঘিরে একদল লোক স্লোগান দিতে থাকলে বার্নিকাট বের হয়ে আসেন। সে সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনৈতিক পত্র পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, দুই ব্যক্তি তখন চিৎকার করে বলছিলেন, ‘বদিউল আলম সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত।’
সে সময় রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দলের দুই সদস্যকে ঘুষি এবং গাড়িবহর চলে যাওয়ার সময় দুটি গাড়িতে লাঠি দিয়ে আঘাতের অভিযোগও করা হয় চিঠিতে।