সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার বাগবাটিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার শিকার হয় কয়েক শ নিরীহ গ্রামবাসী। জ্বালিয়ে দেয়া হয় কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি। হামলায় নিহত গ্রামবাসীকে বিভিন্ন স্থানে দেয়া হয় গণকবর।
সেই গণকবরগুলো এখনও অরক্ষিত। হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিচিহ্ন। গণহত্যায় স্বজন হারাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখতে গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেয়া হোক।
১৯৭১ সালের ২৭ মে ভোরে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নবাসীর। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘেরাও করে ঘুমন্ত নিরীহ মানুষকে পাখির মতো নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পরে ইউনিয়ন পরিষদের পাশে কূপের মধ্যে কিছু লাশ ফেলে দেয় তারা।
শুধু গ্রামবাসী নয়, এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া নিরীহ লোকজনকেও হত্যা করা হয়। এদিন ২ শতাধিক লোককে এভাবে হত্যা করা হয়। বেশির ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত চলে নিষ্ঠুর বর্বর হত্যাযজ্ঞ। শুধু মানুষ হত্যাই নয়, পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা একযোগে লুটতরাজ, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটায়। হত্যার শিকার সাধারণ মানুষগুলোকে নিজ নিজ স্থানেই গণকবর দেয়া হয়।
বাগবাটি ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ অবনি হালদার বলেন, ‘সেদিন আমাদের গ্রামে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মানুষের রক্তে পুরো গ্রাম লাল হয়ে যায়। আমি নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখেছি। সে কথা মনে হলে ভয়ে গা শিউরে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘অযত্ন-অবহেলায় সেই গণকবরগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সংরক্ষণের অভাবে কবরের ওপর মানুষ ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা গড়ে তুলছে।’
বাগবাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের গণহত্যার কথা জানাচ্ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধা বাসনা রানী। তিনি বলেন, ‘সকালে সন্তানদের নিয়ে বাড়িতেই ছিলাম। এ সময় হানাদার বাহিনী গ্রামের চারদিকে হামলা করে। ভয়ে আমার স্বামী জ্ঞানেন্দ্রনাথ পাশের বাড়িতে পালান। রাজাকাররা দেখিয়ে দিলে সেখানেই ব্রাশফায়ার করে তাকে হত্যা করা হয়।’
সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী হারিয়ে বাসনা রানী ছয় সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে যান। অতিকষ্টে বড় করেন তাদের। সন্তানদের লালন-পালন করতে গিয়ে এখন তিনি পঙ্গু, অসুস্থ। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘স্বামী হত্যার বিচার তো পেলামই না। এখন তার কবরটি পর্যন্ত হারিয়ে গেছে।’
একই গ্রামের চিত্তরঞ্জন দত্ত বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আমার বাবা, দাদা, চাচাকে গুলি করে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা তার বিচার পাইনি। তাদের কবরগুলোও আজ হারিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।’
বাগবাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ২ শতাধিকের ওপরে মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে কূপের মধ্যে তাদের অনেকের লাশ ফেলে দেয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে সেখানে এদের নামসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। হত্যার শিকার বাকি শহীদদের নাম কিংবা তাদের গণকবরগুলো আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রতি বছর ২৭ মে আমরা গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে নানা আয়োজন করি।’
সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাগবাটিসহ জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যেসব নিরীহ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে, তাদের শহীদদের স্বীকৃতিসহ গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।’