বর্ষা পেরিয়ে অক্টোবরে শুরু হয়েছে ইট তৈরির নতুন মৌসুম। এখন ভাটাগুলোতে চলছে ইট পোড়ানো। তবে জ্বালানি কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ ভাটায় জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
ইটভাটা আইনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, মানসম্মত কয়লা ছাড়া অন্য কোনো জ্বালানি ইটের ভাটায় ব্যবহার করা যাবে না। প্রশাসনের তদারকির অভাবে নির্বিঘ্নেই এ আইন লঙ্ঘন করে চলেছেন এগুলোর মালিকরা।
মঙ্গলবার দুপুরে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া গ্রামের ভদ্রা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি ভাটার চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওই ধোঁয়ার রং গাঢ় কালো। সাধারণত কয়লা পোড়ালে ধোঁয়া এত বেশি গাঢ় হয় না।
ভদ্রার তীরে রয়েছে প্রায় ১৫টি ইটের ভাটা। সেখানের মেসার্স সেতু ব্রিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ মণ কাঁচা কাঠ স্তূপ করে রাখা। শ্রমিকরা ওই কাঠ নিয়ে ভাটার চিমনির নিচে সাজাচ্ছেন।
ভাটার শ্রমিকরা জানান, কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ইট তৈরিতে খরচ বেড়ে গেছে। তাই বিকল্প উপায় হিসেবে মালিকরা কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছেন। ভদ্রা নদীর তীরে থাকা অধিকাংশ ভাটায় এবার কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
একাধিক ভাটা মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরে প্রতি টন কয়লা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা দরে। এ ছাড়া কয়লার ডিপো থেকে ভাটা পর্যন্ত আনতে ট্রাকের ভাড়া লাগছে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে। অন্যদিকে এক টন কাঠের দাম প্রায় ৮ হাজার টাকা। কয়লার তুলনায় কাঠ পোড়ালে প্রায় ৪ গুণ বেশি লাভ হয়।
ডুমুরিয়া উপজেলার চেয়্যারম্যান এজাজ আহমেদের মালিকানাধীন দুটি ভাটা রয়েছে এ এলাকায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাটায় শুধু কয়লা দিলে আগুন ধরে না। এ জন্য সামান্য কিছু কাঠ দেওয়া হয়। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই অল্প কাঠ ব্যবহার করি। বেশি পরিমাণে কয়লা ব্যবহার করি। কারণ কয়লা ব্যবহার না করলে আগুন নিভে যায়।’
খুলনা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তার মালিকানায় আছে কেপি ব্রিকস নামের একটি ইটের ভাটা।
তিনি বলেন, ‘আমার নিজের ভাটায় কোনো কাঠ পোড়ানো হচ্ছে না। অন্যদের ভাটায় এটা করা হলে আমরা নিষেধ করব।’
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ এই আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বাঁচিয়ে রাখতে হলে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। ইটের ভাটায় কাঠ ব্যবহার করা হলে সেখানে কাঁচা-পাকা, ছোট বড় সব গাছই পোড়ানো হবে। প্রচুর গাছ কাটা পড়বে। এতে একদিকে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে মিশছে। অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অচিরেই তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ না করা গেলে পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।’
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯টি উপজেলার ১৫৩টি ইটের ভাটাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যদিও বাস্তবে ভাটার সংখ্যা আরও বেশি।
২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার ইটের ভাটা প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণ করে। এই দূষক বায়ুমণ্ডলে মিশে স্বাস্থ্য, কৃষি ফলন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে ইটের ভাটায় কাঠ পোড়ানোর কোনো অনুমতি নেই। আমাদের জানা ছিল না ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। আমরা অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’