বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হয়েছে শতবর্ষী রাস পূর্ণিমা পূজা ও পুণ্যস্নান। এ উদ্দেশে রোববার সকাল থেকে সুন্দরবনের আলোরকোলে পুণ্যার্থীদের আগমন শুরু হয়।
৬ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এই রাস পূর্ণিমা পূজা ও পুণ্যস্নান হবে।
রোববার সন্ধ্যায় দুবলার চরের মন্দিরে সান্ধ্যপূজা দিতে ভীড় করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
২০১৯ সালের আগে প্রতিবছর দুবলার চরে পূজার পাশাপাশি রাস মেলাও হতো। হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও প্রতিবছর এই উৎসব ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারও মানুষ অংশ নিতেন। কিন্তু সেবার ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবনে রাস মেলা হয়নি। করোনার কারণেও ২০২০ সাল থেকে মেলা বন্ধ রাখে প্রশাসন। এরপর থেকে সুন্দরবনে পুণ্যার্থী ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত আছে।
রাস উৎসব বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ এড়াতে এবারও স্বল্প পরিসরে রাস উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আশা করছি, এবার সবার সহযোগিতায় আমরা সুষ্ঠুভাবে এ উৎসব সম্পন্ন করতে পারবো।’
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পুণ্যস্নানে তীর্থযাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগ পাঁচটি পথ নির্ধারণ করেছে। এসব পথে বন বিভাগ, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের টহলদল তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দেবে।
এবার দুবলার চরে তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতের প্রক্রিয়া ও কিছু বিধি-নিষেধের কথা জানান সুন্দরবন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে। তিনি বলেন, ‘রোববার দিনের বেলায় দুবলারচরগামী ট্রলারগুলো যাত্রা করবে। শুধু দিনের বেলায়ই এ ট্রলারগুলো চলবে। বনবিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না। প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রং দিয়ে বিএলসি অথবা সিরিয়াল নম্বর লিখে রাখতে হবে।’
তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের ওপর কিছু বিধি-নিষেধের বিষয়ে তিনি জানান, সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থানের সময় টোকেন ও টিকিট নিজের সঙ্গে রাখতে হবে।
এ ছাড়া রাসপূর্ণিমা পুণ্যস্নানের সময় কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারো কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, হরিণ মারার ফাঁদ, দড়ি, গাছ কাটার কুড়াল, করাত ইত্যাদি অবৈধ কিছু পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ট্রলারে কোনো প্লাস্টিকের খাবারের প্লেট বহন করা যাবে না। লঞ্চ, ট্রলার, নৌকায় এবং পুণ্যস্নানের স্থানে মাইক বাজানো, পটকা, বাজি ফুটানোসহ কোনো শব্দ দূষণও করা যাবে না।
সুন্দরবনে প্রবেশের সময় পুণ্যার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া নাগরিকত্ব সনদের মূলকপিও সঙ্গে রাখতে হবে।
রাস উৎসব উপলক্ষ্যে রোববার দুবলার চর অভিমুখে যাত্রা করা কয়েকটি ট্রলার
কিভাবে শুরু হলো রাস উৎসব
হিন্দু ধর্মবলম্বীদের মতে, রাস উৎসব শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয়ভাব ধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথাবস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় রুপান্তরিত করতে এ উৎসব পালন করা হয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বঙ্গপসাগরের চর আলোরকোল এলাকায় বসে পুর্ণিমার জোয়ারে স্নান করে, যাতে তাদের সব পাপমোচন হয়ে যায়।
যদিও ‘রাস-লীলা’ নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। এর মধ্যে দুটি মত বহুল জনপ্রিয়। এর মধ্যে একটি মত অনুসারে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন ও পূণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এ থেকেই শুরু হয় ‘রাস উৎসব’।
আবার অন্য মত অনুসারে, দুর্গাপুজার পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনের গোপীদের সঙ্গে লীলায় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে ‘রাস-লীলা’ পালিত হয়ে আসছে।