দিনাজপুরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম। এই নারী ১৯৯০ সালে সরকার থেকে একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। আর সেই বাড়ির দখল ফিরে পেতে আদালতের বারান্দায় ঘুরেই কেটে গেছে তার ৩০টি বছর। ৫৬ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে তিনি অবশেষে হাজির হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। মামলাটি দ্রুত শেষ করার আর্জি জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতির কাছে।
রোববার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীসহ চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চে বিচার কাজ চলার শেষ মুহূর্তে রোকেয়া বেগম আদালতের ডায়াসে গিয়ে হাজির হন। তখন প্রধান বিচারপতি তার কাছে জানতে চান, ‘কিসের মামলা আপনার?’
রোকেয়া বলেন, ‘আমার বাড়ি নিয়ে মামলা।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার আইনজীবী কে?’
তিনি আইনজীবীর নাম বলতে পারেননি। এ সময় তার মামলার অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড শিরীন আফরোজ রোকেয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এ সময় প্রধান বিচারপতি তার কথা শোনেন এবং তার মামলাটি দ্রুত তালিকায় আসবে বলে আশ্বস্ত করেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে আসার পর রোকেয়া বেগমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
জানা যায়, দিনাজপুর উপশহরের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম আশির দশকের শেষের দিকে সরকার থেকে একটি বাড়ি বরাদ্দ পান। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় সে বাড়ি বেদখল হয়ে যায়। বিচারিক আদালতসহ উচ্চ আদালতের রায়ও রোকেয়া বেগমের পক্ষে হয়। তবু এত বছরেও তিনি বাড়িটি বুঝে নিতে পারেননি।
রোকেয়া বলেন, ‘আদালতের রায় পক্ষে এলেও তারা (বিবাদী পক্ষ) একটির পর একটি আবেদন করে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে চলেছে। তাদের টাকা আছে, তারা আবেদন করে ঝুলিয়ে রাখে। আমাদের টাকাপয়সা নেই। সে কারণে মামলা চালাতে পারি না।’
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে চাকরি করে আসা এই নারীর দুটি কিডনিতেই সমস্যা। হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পোশাক-পরিচ্ছদে অনটনের ছাপ স্পষ্ট।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে চাকরির পর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালের ১০ মার্চ দিনাজপুরের উপশহর এলাকায় পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি বাড়ি বরাদ্দ পান রোকেয়া বেগম। ১৯৯০ সালে বাড়িটি তার নামে তালিকাভুক্ত হলে স্বামী-সন্তান নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
ওই বাড়ির ঠিক বিপরীতে এক বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মো. নুর ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। প্রতিবেশী হওয়ায় এক পর্যায়ে দুই পরিবারের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। একে অপরের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ান।
পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর রোকেয়া বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে দেখেন বরাদ্দ পাওয়া বাড়ি দখলে নিয়েছেন নুর ইসলাম। তার দাবি, স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে যাওয়ার আগে রোকেয়া বেগম ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাড়িটি তার কাছে হস্তান্তর করে গেছেন। প্রমাণ হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষকে ৩০ টাকার স্ট্যাম্পের দখল হস্তান্তরের দলিল দেখান তিনি। এরপর হাউজিং এস্টেটের বিধিমালা অনুযায়ী (খ) তফসিলের বাড়িটি তার নামে তালিকাভুক্ত করতে নির্ধারিত ফরমের মাধ্যমে আবেদন করেন তিনি। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাড়িটি সরেজমিন পরিদর্শন করে নুর ইসলামের বাড়ি কেনার আবেদনটি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কমিশনার সেটেলমেন্ট অফিসে পাঠিয়ে দেন।
পূর্ত মন্ত্রণালয় ১৯৯০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাড়িটি কেনার জন্য নুর ইসলামকে চিঠি দেয়। এ চিঠির পর ১৯৯১ সালের ২৩ মার্চ নুর ইসলামের নামে বাড়িটি বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু বরাদ্দের ওই আদেশে বাড়ির দাম ধরা হয় ৪০ হাজার টাকা। ফলে বাকি ২০ হাজার টাকা তাকে কিস্তিতে পরিশোধ করতে বলা হয়। বরাদ্দ পাওয়ার পর ১৯৯১ সালের ২৭ মার্চ প্রথম কিস্তির ৬ হাজার ৮৮২ টাকা পরিশোধও করেন নুর ইসলাম।
এ ঘটনায় জোর করে বাড়ি দখলে নেয়ার অভিযোগ এনে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অফিসে লিখিত অভিযোগ করেন রোকেয়া বেগম। অভিযোগ পেয়ে তা তদন্তের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। তদন্তে নুর ইসলাম বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় মন্ত্রণালয় ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট নুর ইসলামের বরাদ্দ আদেশ বাতিল করে। দখলদার নুর ইসলাম বরাদ্দ বাতিলের এই আদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে স্থানীয় সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে আবেদন করেন।
মন্ত্রণালয় ১৯৯৪ সালের ২ জানুয়ারি পুনর্বিবেচনার আবেদনটি খারিজ করে নুর ইসলামকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়। নোটিশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে বলা হলেও নুর ইসলাম বাড়ি ছাড়েননি। এ অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট বাড়িটি দখলমুক্ত করতে গেলে নুর ইসলাম তাকে জানান, এ বাড়ি নিয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন এবং বাড়িটিতে আদালতের স্থিতাবস্থা রয়েছে। ফলে বাড়ি আর দখলমুক্ত হয়নি।
এরপর ২০০১ সালে দিনাজপুরের জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ নুর ইসলামের মামলাটি খারিজ করে দিলে এর বিরুদ্ধে দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে আপিল করেন নুর ইসলাম। ২০০৪ সালে সে আপিলটিও খারিজ করে দেয় আদালত। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত বছরের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টও নুর ইসলামের আপিল খারিজ করে দেয়। এই পর্যায়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন নুর ইসলাম, যা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে আইনি সহায়তা পেতে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড অফিসে যোগাযোগ করেন রোকেয়া বেগম। মামলাটি পর্যালোচনা করে তাকে আইনি সহায়তা দিতে আইনজীবী শিরীন আফরোজকে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস।
স্বামী অসুস্থ থাকায় রোকেয়া বেগমই আদালতে হাজির হয়েছেন। তার দুই সন্তানের মধ্যে মেয়েটি মারা গেছে। আর গার্মেন্ট কর্মী ছেলে আব্দুল্লাহ আল মেহেদী মেরাজ থাকেন টঙ্গীতে।