কোটি টাকা তার কাছে ১০ টাকার নোটের মতো! শতকোটির বিদেশি জাহাজ যেন বাড়িতে ব্যবহারের বাইসাইকেল!
নানা মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে অসংখ্য প্রতারণায় তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকা। ভুক্তভোগী আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধোঁকা দিতে বদলে ফেলেছেন নিজের চেহারাও।
একসময়ের টাক মাথার মেজবাহ এখন হেয়ার প্ল্যান্টেশন করে মাথায় চুল বসিয়ে পুরোদস্তুর অন্য মানুষ।
সাত বছরের প্রতারক জীবনে তার ঝুলিতে জমেছে ২২টি মামলা। এর মধ্যে রায় হয়েছে ১১টির। বাকি ১১টিতে ছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
কিন্তু কথায় আছে- ‘চোরের দশ দিন আর গৃহস্থের এক দিন’। মেজবার ক্ষেত্রেও তার প্রমাণ মিলল। সাত বছর ধরে প্রতারণার পর অবশেষে র্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন ধুরন্ধর এই প্রতারক।
সোমবার দুপুরে র্যাব-৭-এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতারক মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে আটকের কথা জানান বাহিনীর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ।
রোববার রাত ১০টার দিকে নগরীর হামজারবাগে আজাদ কমিউনিটি সেন্টারের ওপরের একটি বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। আটক মেজবাহ হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তাহের চৌধুরীর ছেলে।
র্যাব অধিনায়ক জানান, বাবা একসময়ের ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ায় মেজবাহ ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের ছেলে। প্রচুর ধনসম্পদ ছিল তাদের। আট ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের পর ব্যবসায় ঢুকে পড়েন। ১৯৯৮ সালে বাবার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসা শুরু করেন।
অল্প পুঁজিতে শুরু করা ব্যবসায় কিছু লাভের পর তিনি অংশীদার নিয়ে আসেন। অনেকের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন। পরে আরও ভালো করার পর তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। বড় বিনিয়োগের চিন্তা শুরু করেন তিনি।
এ অবস্থায় লাভের টাকা দেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া শুরু করেন। এভাবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার ব্যবসা চলতে থাকে।
২০০৮ সালের পর ক্ষতির মুখে পড়ে তার ব্যবসা। ধার করা টাকা ফেরত দিতে না পেরে চাপে পড়েন তিনি।
এ সময়ই প্রতারণার পথে পা বাড়ান মেজবাহ।
প্রতারণার পথে পা বাড়ানো
লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, ‘সে যেহেতু এই ব্যবসায় অনেক দিন ছিল, তাই অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে।’
এম এ ইউসুফ জানান, ২০১৪-১৫ সালের দিকে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে একটা জাহাজ দেখিয়ে এবং এটা নিজে কিনেছেন জানিয়ে স্ক্র্যাপ বিক্রির পর লভ্যাংশ ভাগ করার কথা বলে বিভিন্ন জনকে বিনিয়োগে আহ্বান করেন। এ সময় কেউ ৫০ লাখ, কেউ ১ কোটি, কেউ দেড় কোটি টাকাও তাকে দেন।
কিন্তু বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পরও সেই জাহাজ যখন কাটা হচ্ছিল না, তখন সবাই তাকে চাপ দেয়া শুরু করেন। এ সময় নতুন আরেক গল্প নিয়ে আসেন তিনি। পাওনাদারদের এবার আরেকটি জাহাজ দেখান। সেই জাহাজে কিছু পরিত্যক্ত বক্স ছিল কনটেইনারের মতো। এগুলো দেখিয়ে পাওনাদারদের তিনি বলেন, বিদেশ থেকে জাহাজটি কেনার পর এটিতে প্রচুর সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো তিনি ৫০০ কোটি দামে দেশের বাইরেই বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার টাকাটা বড় অঙ্কের হওয়ায় আটকে দিয়েছে। এটা উদ্ধার হলে তিনি সবার টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতারক মেজবাহ সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরেন র্যাব অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ
এ ছাড়া আরও একটি গল্প তৈরি করেন তিনি। দাবি করেন, ওই জাহাজে পাঁচটি ডায়মন্ড রয়েছে। প্রতিটির মূল্য ২ হাজার কোটি টাকা। ডায়মন্ডগুলোর জন্য সরকারের বিভিন্ন লোকজনকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এতদিন যে টাকাগুলো লোকজনের কাছ থেকে নিয়েছিলেন সেগুলো দিয়েই তিনি সরকারের লোকজনকে ম্যানেজ করেছেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। জাহাজে থাকা পাঁচটি ডায়মন্ডের একটি তিনি পাবেন। বাকিগুলো দিয়ে সরকারের বিভিন্ন জনকে ম্যানেজ করতে হবে।
যেভাবে ধরা পড়লেন মেজবাহ
প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত মেজবাহকে ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল উল্লেখ করে র্যাব অধিনায়ক জানান, শুরুতে তারা ভেবেছিলেন- মেজবাহ দেশে নেই। কারণ কোনোভাবেই তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না।
এম এ ইউসুফ বলেন, ‘গত সাত বছরে সে কয়েক শ মোবাইল সিম ব্যবহার করেছে। কোনো সিম সে তার কাছে রাখত না। চট্টগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে কোথাও বসবাসও করত না। চট্টগ্রামে এলে খুব অল্প সময়ের জন্য ভাই-বোনদের বাসায় থাকত।
‘ঢাকায়ও তার কোনো স্থায়ী নিবাস ছিল না। বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান করত। সব মিলিয়ে খুবই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। আমরা যে ছবি পেয়েছি তার মাথায় চুল নেই।’
র্যাব জানায়, মাঝেমধ্যে অ্যাপস ব্যবহার করে বিভিন্নজনকে কল দিতেন মেজবাহ। কিন্তু সবগুলো নম্বরই দেশের বাইরের নম্বরের মতো দেখা যেত। তার পরও র্যাব তাকে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারের গোয়েন্দা বিভাগেরও সাহায্য নেয় এ বাহিনী। অফিসাররা নিয়মিত চেষ্টা করছিলেন কোনো একটা ক্লু বের করার জন্য।
অবশেষে রোববার হঠাৎ খবর পাওয়া যায়, চট্টগ্রামে বোনের বাসায় এসে উঠেছেন মেজবাহ। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানের শুরুতে মেজবাহর বোন প্রায় ১ ঘণ্টা বিভিন্ন অজুহাতে ঝামেলা তৈরির চেষ্টা করেন বলে জানায় র্যাব। পরে তারা সফল হয়।
গ্রেপ্তারের পর মেজবাহর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান লে. কর্নেল।