মোহাম্মদ ইসমাঈল। পেশায় কৃষক। বসবাস মিয়ানমার সীমান্তের ৩৩ নম্বর পিলার থেকে ২০০ গজ ভেতরে বাংলাদেশের তুমব্রুর মাঝেরপাড়া এলাকায়।
মর্টার শেল বিস্ফোরণের খবরে আতঙ্কে থাকলেও বসতবাড়ি না ছাড়তে অনড় ইসমাঈল। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে প্রাণ দেব, তবুও তুমব্রুর মাটি, বসতবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।
‘গোলার শব্দ, সে তো নিত্যসঙ্গী। তাহলে কেন বাড়ি ছাড়ব? বিভিন্ন সময় চলাচলে সতর্ক করছে বিজিবি।’
তিনি নিউজবাংলাকে জানান, তার তিন সন্তান আছে। তাদের একজন ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারাও মাঝে মাঝে এসে গোলার শব্দ শুনে ভয়ের কথা জানাত, কিন্তু এখন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলে শুক্রবার রাতে সীমান্তের শূন্যরেখায় এক রোহিঙ্গা নিহতের পর শনি ও রোববার সকালেও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে দফায় দফায় বিকট গোলার শব্দ শোনা গেছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে, তবে সীমান্তের ৫ গ্রামে গিয়ে এর সত্যতা মেলেনি।
সীমান্ত লাগোয়া নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর উত্তরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মাঝেরপাড়া, বাইশফাঁড়ির একাংশ ও তুমব্রুর বাজার এলাকার কেউই ইসমাঈলের মতো বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে নন।
উত্তরপাড়ার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে, তবুও পরিবার নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছি না সহজেই। যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেন, আমার এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে নই।
‘আমাদের জন্ম এখানে, বেড়ে ওঠাও এখানে। কীভাবে এত সহজে ছেড়ে যাই?’
ইজিবাইকচালক হামিদুল হক বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান নিয়েই থাকছি শেকড় থেকে। এখানে আমাদের সবকিছু। গোলার শব্দ তো আগেও হয়েছে। কই, আমরা তো বাড়ি ছেড়ে যাইনি।
‘পরিস্থিতি থাকবে, সমাধানও হবে। তাহলে ছেড়ে যাব কেন?’
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রোববার সকালেও দুই দফা গোলার শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয়রা ভয়, আতঙ্কে আছে।
‘কেউ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে নয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কাউকে সরিয়ে আনার কথা বলা হয়নি। নিজ উদ্যোগেও কেউ সরেনি।’
তিনি আরও বলেন, রোববার উপজেলা পরিষদেও বৈঠক হয়েছে। সেখানে স্থানীয় জনগণকে সরিয়ে আনার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। চলাচলে সতর্ক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইয়াসমিন পারভিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি আমরা পর্যাবেক্ষণ করছি। কোনো স্থানীয় বাসিন্দাকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়নি।
‘কোনো রোহিঙ্গা যাতে ওপার থেকে দালালদের হাত ধরে এপারে আসতে না পারে, সেদিকেও প্রশাসন নজরদারি রেখেছে। এ ছাড়াও কোনো দালালকে চিহ্নিত করা গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সীমান্তে উত্তেজনা
প্রায় এক মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল, গোলাগুলিসহ নানা ভারী অস্ত্রের আওয়াজে এপারের তুমব্রু ও বাইশপারী এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে।
বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে পড়েছে।
সবশেষ শুক্রবার রাতে তুমব্রুর কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হন। আহত হয় রোহিঙ্গা শিশুসহ ৫ জন।
এর আগে একই দিন দুপুরে এই সীমান্তেই হেডম্যানপাড়ার ৩৫ নম্বর পিলারের ৩০০ মিটার অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন বাংলাদেশি এক যুবক।
আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলম।
গত ২৮ আগস্ট তুমব্রু উত্তরপাড়ায় একটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সেদিনই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে দেখা যায়।
এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় পড়ে। সেগুলো অবিস্ফোরিত থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর তিন দিন পর ফের ওই সীমান্তে ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ ভেসে আসে।
রাষ্ট্রদূতকে তলব
সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থবারের মতো তলবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়েছিলেন ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির দূত অং কিয়াউ মো।
সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার পর হাজির হন দূত। সেখানে আধাঘণ্টা ছিলেন তিনি।
ওই সময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমারবিষয়ক ডেস্কের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহাপরিচালক নাজমুল হুদা।