বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৭ সালে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের অন্যায়ভাবে প্রক্রিয়া না মেনেই ফাঁসি দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এসব ফাঁসিকে প্রহসনমূলক হত্যা উল্লেখ করে সে সময়ের জিয়ার মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক গুম দিবসে মঙ্গলবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা’ ব্যানারে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে তিনি এসব কথা বলেন।
এতে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে গুম এবং হত্যা জিয়াই শুরু করেন। জীবনকে বাঁজি রেখে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে সেই তাদেরকেই ফাঁসি দেন জিয়াউর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘বিচার করার বিধি-বিধান আছে। কিন্তু কোনো নিয়ম জিয়া মানে নাই। নাম একজনের দেখে আরেকজনকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগে গুম করা হয়েছে তারপরে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তাদের লাশটা পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। আজকে স্বজনদের আর্তনাদ শুনতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে নজির রয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা অপরাধ করলে তাদের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর এখানে তাদেরকে বিচার করার আগেই ফাঁসি দেয়া হযেছে।’
জিয়ার মরণোত্তর বিচারের দাবি জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, ‘একটু আগে বিচারপতি বলে গেলেন মৃত ব্যক্তিদের বিচার হয় না। তবে গণদাবিতে অনেক কিছুই হয়। আইনের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। গণমানুষের প্রয়োজনে আইনের ব্যত্যয়ও ঘটে। পৃথিবীতে মরণোত্তর বিচারের নজির আছে। বহু দেশে মরণোত্তর বিচার হয়েছে।
‘সেই দায়িত্বববোধ থেকে জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় ও জরুরি। এটা করা কোনো বেআইনিও হবে না।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘আজ একটি নারকীয় দিবস। এ রকম নারকীয় দিবস আমাদের দেশে অনেক হয়েছে, যার শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছিল। এ রকমই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৭৭ সালে।
‘১৯৭৭ সালে বিচারের নামে দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। বিচারের কোনো প্রক্রিয়াই মানা হয়নি। তাদের লাশ কোথায় আছে সেটা আজও অনেকেই জানে না।’
পরিবারের সদস্যদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তারা বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তাদের দাবিগুলো মেনে নেয়া হোক।’
সংসদ ভবনে জিয়ার কবর থাকতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন মানিক।
সভাপতির বক্তব্যে ১৯৭৭ সালের সামরিক আদালতে বিচারের ভুক্তভোগী সার্জেন্ট আবুল বাসার খানের মেয়ে বিলকিস বেগম বলেন, ‘বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর আমাদের কেউ কোনো খোঁজ রাখেনি। চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সময় পার করেছি, জানি না কোথায় বাবার কবর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আবেদন, তিনি ১৯৭৭ সালের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার যেন করেন।’
তিনি বলেন, ‘এতটা সময় পার করেছি, কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার মায়ের দাবি, সবাই যেন জানে, আমার বাবা নির্দোষ ছিল।’
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন মেজর জেলারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ বীর বিক্রম, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হকসহ ১৯৭৭ সালে ‘গণফাঁসি’ ও ‘গণগুমের’ শিকার সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের সন্তানরা।
কী ঘটেছিল সে সময়
১৯৭৭ সালে জাপানের উগ্রপন্থি গোষ্ঠী ‘রেড আর্মির’ সদস্যরা জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে (বর্তমান পুরাতন বিমানবন্দর) অবতরণ করিয়েছিল। ওই ঘটনার অবসানের ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধানসহ বিমান বাহিনীর বিরাট একটা অংশ সার্বক্ষণিকভাবে কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১ অক্টোবর যখন বিমান ছিনতাই ঘটনার অবসান ঘটে, সেই রাতে জিয়াউর রহমানের অনুগত বাহিনী ঢাকা সেনা ও বিমান বাহিনীর ছাউনিতে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। তারা শত শত ঘুমন্ত সৈনিককে ব্যারাক থেকে অস্ত্রের মুখে বের করে নিয়ে আসে এবং পরে তাদেরকেই অভুত্থানের অভিযাগে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করে।
লিফলেটে বলা হয়, ষড়যন্ত্রকারীরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিভিন্ন নির্যাতন কক্ষে নিমর্মভাবে পিটিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে শত শত সৈনিককে হত্যা করে। বিভিন্ন ট্রাইবুনালে বিচারের নামে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অন্যায়ভাবে ফঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়। কত সৈনিককে এই শাস্তি পেতে হয়েছিল, তার খবর দেশবাসী আজও সঠিকভাবে জানে না।
এতে বলা হয়, ফায়ারিং স্কোয়াড ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রায় এক হাজার চারশ সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়। ওইদিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে ও সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থানে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং ফায়ারিং স্কোয়াড যাদেরকে মারা হয়েছে তাদের হিসাব জানা নাই।
জিজ্ঞাসাবাদের নামে সৈনিকদেরকে হাত, পা ও চোখ বেঁধে দিনের পর দিন ফেলে রাখার অভিযোগও করা হয় লিফলেটে। বলা হয়, চোখ বাঁধা অবস্থাতেই সৈনিকদের অনেকের সই নেয়া হয় কোনো অজানা কারণে।
প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কোনো অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি দেয়া হয় না। কিন্তু সে সময় নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত অর্ধমৃত সৈনিকদেরকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
আগে ফাঁসি পরে বিচারের রায়
আয়োজকরা জানান, ফাঁসি দেয়া শুরু হয় ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর থেকে। কিন্তু আদেশ জারি হয় তার ৬ দিন পর ১৪ অক্টোবর থেকে।
জিয়াউর রহমানের গঠন করা ‘মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল’ একেকজন সৈনিকের জীবণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিল।
যারা ট্রাইব্যুনালের বিচারক হয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী অনেকেরই বিচারক হওয়ার যোগ্যতাই ছিল না।
মার্শাল-ল ট্রাইবুনালের নিয়ম অনুযায়ী বিচারক হয় পাঁচ জনকে নিয়ে। এদের একজন হবেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বাকি চার জন ক্যাপ্টেন।
কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের মতো করে বিচারক সাজিয়েছিলেন। একজন কমিশনড অফিসার আর বাকি চার জন ছিলেন হাবিলদার ও সিপাহি।
তারা নিজের খেয়াল খুশিমতো রায় দিয়েছে। কোনো রায় সৈনিকদেরকে শোনানো হয়নি।
সাত দফা
সভায় ১৯৭৭ সালের ঘটনার ভুক্তভোগী স্বজনদের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি পেশ করা হয়।
দাবিগুলো হলো:
১. ১৯৭৭ সনের অক্টোবরে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যারা অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের নির্দোষ ঘোষণা;
২. সেদিন যারা সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ফাঁসি-কারাদণ্ড ও চাকুরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র্যাংকে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা ও পেনশনসহ সরকারি সব সুযোগ সুবিধা প্রদান;
৩. সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা ও বিমান বাহিনী সদস্যদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি হয়েছে, তাদেরকে শহীদ হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা এবং কবরস্থান চিহ্নিত করে কবরস্থানে নামসহ স্মৃতি ফলক তৈরি;
৪. যারা সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, সেই সকল সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে তাদের পোষ্যদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ;
৫. সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি কারাদণ্ড ও চাকুরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রকাশ;
৬. অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত করার অপরাধে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার;
এবং
৭. জিয়াউর রহমানের ‘তথাকথিত’ কবর জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে অপসারণ করা।