ঠাকুরগাঁওয়ে হিমাগারে সংরক্ষণে রাখা আলুতে পচন ধরেছে। এতে ব্যাপক লোকসানের আশংকায় পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
অভিযোগ, অধিক মুনাফার জন্য হিমাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি আলু সংরক্ষণ করেছেন মালিকেরা। এ কারণেই বস্তা বস্তা আলু পচে যাচ্ছে।
কৃষক মাহাবুল ইসলাম, হাসেম আলী, রফিকুল ইসলাম রমজান আলীসহ ব্যবসায়ীদের একই কথা, হিমাগারে এসব পচা আলুর দায় নেবে কে?
হিমাগার কর্তৃপক্ষ বলছে, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এমনটি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁওয়ে এবার ২৭ হাজার ৬৭৭ হেক্টর জমিতে আবাদ করে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৪ টন আলু উৎপাদন হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর প্রতি ৫০ কেজি আলুর বস্তা হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য ভাড়া বাড়িয়ে ২৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। এ ভাড়া কমানোর দাবিতে ঠাকুরগাঁওয়ে আন্দোলন করেও লাভ হয়নি। অধিক ভাড়া দিয়ে রেখেও আলু পচে যাওয়ায় ক্ষুদ্ধ তারা। এর তদন্ত চান কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
সদরের রহিমানপুরে কৃষক মাহাবুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৭ বিঘা জমিতে আলু করেছি। ফলন অনেক ভালো হয়েছে। প্রায় দুই হাজার বস্তা হিমাগারে সংরক্ষণ করেছি। এত আন্দোলন করেও কোনো লাভ হয়নি। হিমাগার মালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে তাদের নির্ধারিত দামে আলু রাখতে হয়েছে।
‘এখন দেখছি আমার প্রতি বস্তাতে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ আলু পচে গেছে। আমি পচা আলু দিয়ে কি করব। আমি ক্ষতিপূরণ চাই।’
কচুবাড়ি এলাকার হাসেম আলী বলেন, ‘অধিক মুনাফার জন্য হিমাগার মালিকেরা ধারণক্ষমতার বেশি আলু হিমাগারে ঢুকিয়েছে। ৬ বস্তার খামালের জায়গায় ৯ বস্তার খামাল করেছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আলু উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকদের কাছে সুযোগ নিয়েছে তারা। আমাদের ঘাড়ের উপর বস্তা প্রতি ২৬০ টাকা ভাড়া চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা নিরুপায়। আমার উৎপাদিত আলুর ক্ষতিপূরণ না পেলে আলু উৎপাদন করব না।’
ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একজন কৃষক হিসেবে উৎপাদন করে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন আমার পচা আলুর দায় কে নেবে? হয় আমাকে আমার ক্ষতিপূরণ দিন, নয়তো আমার ঋণের দায় নিন। অন্যথায় আমি আত্মহত্যা করব।’
হিমাগার মালিকদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এমন দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন আলু ব্যবসায়ীরা।
কৃষক ও আলু ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কৃষকদের সঙ্গে সব সময় একাত্মতা পোষণ করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কৃষকদের সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা হিমাগার থেকে আলু কিনব না এবং বাজারে আলু পাঠাব না। কৃষকরা আলু উৎপাদন করেছে, হিমাগার সেটা পচিয়ে ফেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, তা হতে পারে না।’
আলুর ক্ষতিপূরণ না পেলে মামলার হুমকি দিয়েছেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সামাদ হেলাল। তিনি বলেন, ‘হিমাগার কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেয়া ভাড়া কমানোর দাবিতে আমরা বারবার বলে এসেছি। কিন্তু তারা কমাননি। এত বেশি ভাড়া দিয়েও কৃষক ও ব্যবসায়ীর আমানত রক্ষা করতে পারেনি। প্রত্যেকটি হিমাগারে আলু পচেছে। এর দায় হিমাগার কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। নয়তো আমরা আদালতে মামলা করব।’
এ বিষয়ে জানতে ঠাকুরগাঁও হিমাগার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানার সঙ্গে দুই দিন মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ধরেননি।
জেলার ১৭টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫০ টন। ধারণক্ষমতার বেশি আলু সংরক্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ।
রাহবার হিমাগারের ম্যানেজার মনোজ ঘোষ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হিমাগারের ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টন। এই ধারণক্ষমতার মধ্যেই আলু রাখা হয়েছে।’
শাহি হিমাগারের ম্যানেজার ফজলুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ধারণক্ষমতার বাইরে আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করিনি। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে।’
হিমাদ্রি হিমাগার, হাওলাদার হিমাগারসহ বেশ কয়েকটি হিমাগার কর্তৃপক্ষের দাবি, তারাও ধারণক্ষমতার মধ্যেই আলু সংরক্ষণ করেছেন।
এদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এমনটি হয়েছে দাবি করে এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আড়তের সমবায় হিমাগারের পরিচালক দুলাল হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই হিমাগারে আলুর কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি নিজেও এখানে আলু রেখেছি, আমার আলু ঠিক আছে। কৃষকের স্বার্থে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেই বাকি হিমাগারগুলোতে কী কারণে আলু পচেছে, তা বেরিয়ে আসবে।’
ঠাকুরগাঁওয়ের ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুন নষ্ট হলে আলুর এত বাম্পার ফলন হত না। হিমাগারের অব্যবস্থাপনা, গাফিলাতির কারণে আলু পচে যেতে পারে।’
জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘হিমাগারে যারা আলু রেখেছেন, তাদের সঙ্গে হিমাগার কর্তৃপক্ষের চুক্তির বিষয়। এখানে যদি কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হয়, সে ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উভয়ের যাতে ক্ষতি না হয়, সে দিক বিবেচনা রেখে উভয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’