বাড়ির ছাদ থেকে প্রমত্ত পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের অহংকারের প্রতীক পদ্মা সেতু স্পষ্ট দেখা গেলেও, দূরত্ব নেহাত কম নয়। সেতু দিয়ে যান চলাচল করলে সেটা বোঝা যায়, দেখা যায় আবছা।
তবুও আগ্রহের কমতি নেই জীবন বাবুর পরিবারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সেতু পাড়ি দেবেন, সেই দৃশ্যটি দেখতে বাড়ির ছাদে জড়ো হয়েছেন তার পরিবারের সব সদস্য।
পুরো নাম জীবন দাশ। পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের মেদিনীমণ্ডলে তার বাড়ি। ৪০ বছর ধরে থাকছেন এখানে। অবশ্য এখন যে পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে সেতু দেখছেন, সেই বাড়িটি বেশি পুরোনো নয়। বছর দুয়েক হলো শেষ হয়েছে নির্মাণ কাজ।
জীবন বাবু জানালেন তাদের বাড়ি ছিল মাওয়া গ্রামে। সেসব অনেক বছর আগের কথা। খরস্রোতা পদ্মার ভাঙনে তলিয়ে গেছে সেই গ্রাম। হারিয়ে গেছে তাদের বাড়ি। তিনি জানালেন, ‘মাঝনদীতে আমাদের ওই গ্রাম ছিল। যেখানে আমাদের বাড়ি ছিল।’
ছাদ আয়োজন নিয়ে জানতে চাইলে জীবন দাশ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাবেন সেতু পার হয়ে। সেই দৃশ্যটি নিজ চোখে দেখতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রীর সেতু পাড়ি দেয়ার সময় থাকতে পারে কড়া রোদ্দুর। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের কষ্ট বাড়বে তাতে। তাই শামিয়ানা টানানো হয়েছে ছাদে। তার নিচেই আয়োজন করে বসেছেন সবাই।
নিজের ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি সবাই মিলিত হয়েছেন বাড়ির ছাদে। মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল, কামারগাঁও, শ্রীনগর থেকে আত্মীয়স্বজনরাও এসেছেন তার বাড়িতে। জীবন জানালেন, ‘বাড়ির ছাদ থেকে পদ্মা সেতু দেখা যায়- এটা সবাই জানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজকে যাবেন, সেটা দেখার জন্যই তারাও এসেছেন আমাদের বাড়িতে।’
আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী সুধী সমাবেশে যোগ দেয়ার সুযোগ নেই কারও। নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকল্প এলাকায় যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সেতু পাড়ি দেবেন, সেই দৃশ্যটা নিজেদের বঞ্চিত করতে চান না তারা।
জীবন দাশ বলেন, ‘টেলিভিশনে সব দেখার সুযোগ থাকলেও নিজ চোখে দেখার যে আনন্দ সেটা তো অন্য রকমের।’
মাওয়া বাজারে মিষ্টির দোকানি দুলাল। তার বয়স ৫০ বছর। জীবন বাবুর বাড়িতে ভাড়া থাকেন তিনি। যোগ দিয়েছেন ছাদের আয়োজনে।
নিউজবাংলাকে দুলাল বলেন, ‘আমি এখানে আসছি প্রধানমন্ত্রী আসব। এত্ত বড় একটা প্রোগ্রাম। আমার সঙ্গে বউ পোলারাও আসছে।’
গৃহিণী মিনা রাণী দাশ বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে দেখার জন্যই ছাদে আইসা বসছি। শেখ হাসিনা গাড়ি দিয়ে যাবে ওই পাড়, সেটা দেখব।’
গৃহস্থ সব কাজ ছেড়ে ছাদে অপেক্ষারত ৬০ বছর বয়সী এই নারী আরও বলেন, ‘খুব আনন্দ লাগতেছে, শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করে দিছে। আজকের দিনে বেশি আনন্দ লাগতেছে। এই আনন্দ আমাদের দুর্গাপূজার চেয়েও বেশি।’
বুড়োদের সঙ্গে শিশুদের উচ্ছ্বাসেরও কমতি নেই। যদিও পদ্মা সেতুর তাৎপর্য বুঝে ওঠার বয়স তাদের হয়নি। তারা জানে না কত দীর্ঘ অপেক্ষার পর নির্মিত হয়েছে এই সেতু। এটি নির্মাণ করতে গিয়ে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সরকারকে। তাদের কাছে নিছক একটি স্থাপনা এই সেতু। তাই বাড়ির সবার সঙ্গে আনন্দ উদযাপনই মূল লক্ষ্য তাদের।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র উৎসব দাশ ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে নিজেরাও পলিথিন টানিয়ে শামিয়ানা বানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে দেখব। কিন্তু রোদ বেশি। তাই এই পলিথিন টানিয়েছি আমরা।’
এত গেল জীবন দাশের ছাদের গল্প। আশপাশের ছাদের দিকে তাকালেও চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে দেয়া সূচি অনুযায়ী, সুধী সমাবেশ শেষে বেলা ১১টার দিকে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করবেন সরকারপ্রধান। পদ্মা সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেয়ার কথাও রয়েছে তার।
বেলা ১১টা ১২ মিনিটে টোল দিয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর ১১টা ২৩ মিনিটের দিকে পদ্মা সেতু পাড়ি দেবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এ সময় কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থেকে নেমে সেতুতে পায়চারি করতে পারেন তিনি।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পৌঁছেই পদ্মা সেতুর আরেকটি উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর কাঁঠালবাড়ীর ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাটে আওয়ামী লীগের জনসভায় দলপ্রধান হিসেবে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়ার সময় পদ্মায় নৌ মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে। ৩১টি বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে ফ্লাইং পাস্ট করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বিমান বাহিনী। এই বহরে আছে মিগ-২৯-এর মতো যুদ্ধবিমানও।
রোববার ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে পদ্মা সেতু। ফুরাবে ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনা, বাঁচবে সময়। বদলে যাবে দৃশ্যপট, আরও সচল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা।