বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছেলেকে নিয়ে চালক বাবার স্বপ্ন-সাধ

  •    
  • ১৯ জুন, ২০২২ ০৮:২৩

উবার চালক বাবা স্বপ্ন দেখেছেন ছেলের ভবিষ্যতের। সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বা বস্ত্র প্রকৌশলে পড়ছেন উইলিয়াম তালুকদারের সন্তান।

গাড়িচালক উইলিয়াম তালুকদারের স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলেকে প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তুলবেন। ছেলেকে কষ্ট করে ভর্তি করান রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। খরচ চালাতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় সেখানে পড়াশোনা। চোখের সামনে স্বপ্ন শেষ হতে দেখে হতাশ হয়ে পড়েন উইলিয়াম।

এক সহকর্মীর পরামর্শে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবার-এ রেজিস্ট্রেশন করে উবার চালানো শুরু করেন তিনি। ছেলের স্কুলের বকেয়া ফি চুকিয়ে দেয়া সম্ভব হয় তার পক্ষে।

ছেলেকে নিয়ে উইলিয়ামের স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। তার ছেলে এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বা বস্ত্র প্রকৌশলে পড়ছেন।

বাবা দিবস উপলক্ষে উইলিয়াম তালুকদার তার স্বপ্ন পূরণের গল্প শোনান নিউজবাংলাকে। কথার মাঝে তুলে ধরেন উবারে গাড়ি চালানোর আগের কষ্টের জীবন ও উবারে গাড়ি চালানোর পরবর্তী সুখের জীবনের গল্প।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘উবারে গাড়ি চালানোর আগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পরিবহনে ট্রিপ দিতাম। সে ক্ষেত্রে আমার অনেক সমস্যা হতো। মালিকের টার্গেট, ট্রিপ অনুযায়ী বেতন, বেশি যাত্রী নেয়ার জন্য রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠাতাম, প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুর্ঘটনার ভয় থাকত, মালিকের চাপ, হেলপার টাকা চুরি করে, যাত্রীদের খিস্তি ইত্যাদি। সব সময় একটা দুশ্চিন্তায় কাজ করতে হতো। তখন এক দিন পর এক দিন ডিউটি করতাম। এক কথায় নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না।’

গাড়িতে উইলিয়াম তালুকদার। ছবি: নিউজবাংলা

উইলিয়াম বলেন, ‘উবার যখন বাংলাদেশে প্রথম আসে, এক গাড়ির হেলপার আমায় বলেন, উবার চালালে ভালো উপার্জন করা যাবে। পরে উবারের অফিস খুঁজে বের করে আমার বায়োডাটা দিয়ে উবারে রেজিস্ট্রেশন করলাম। তারা আমাকে একটা ট্রেনিং করায়। হেলপার একজন মালিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে গাড়ি দিলেন উবারে চালাতে।

‘২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই উবারের সঙ্গে যাত্রা শুরু আমার। শুরুতে গাড়ির মালিক দিনে এক হাজার টাকা বেতন দিতেন। এখন ফিফটি-ফিফটি শেয়ারে গাড়ি চালাই।’

উলিয়াম বলেন, ‘অভাবের কারণে ছেলের পড়াশোনা বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। উবার চালিয়ে আবার যখন সচ্ছল হলাম, ছেলে তখন আবার পড়াশোনা শুরু করল। গাড়ি চালিয়ে এখন ভালো উপার্জন করছি। আমার স্বপ্ন ধীরে ধীরে সত্যি হচ্ছে।’

শুধু তো উপার্জনের জন্যে গাড়ি চালানো নয়, মানুষের সেবাও করা হয়। তিনি বলেন, ‘করোনার সময় অনেক করোনা রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি। একবার গভীর রাতে মিরপুর তালতলা এলাকায় এক করোনা রোগীর রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করার পর তিনি অনেক অনুরোধ করেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি আমাকে বলেন, করোনা পজেটিভ শুনে কেউ তাকে হাসপাতালে যেতে সাহায্য করছে না। আমি তো উবারে এসেছি মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য। সেই দায়বদ্ধতা থেকে ওই করোনা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। এ রকম অনেক উপকার করেছি উবার চালিয়ে।’

উবারের সুফলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাস চালানোর সময় ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে ঝামেলা হতো। এমনকি মালিকের সঙ্গেও ঝামেলা হতো। কিন্তু উবারে এই সমস্যা নাই। গাড়ি চালানোর জন্য সুন্দর একটা পরিবেশ পেয়েছি। উবার চালিয়ে ঢাকায় অনেক অপরিচিত জায়গা চিনেছি। অনেক ভালো ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। উবার বোনাস দিচ্ছে। সব মিলিয়ে উবার চালিয়ে ভালোই আছি।

উইলিয়াম তালুকদারের ছেলে শোভন তালুকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উবার চালানোর আগে বাবা যখন সাধারণ পরিবহন চালাতেন, তখন আমাদের পরিবার অনেক কষ্ট করে চলত। বাবা এক দিন পর এক দিন গাড়ি চালিয়ে একটা নির্দিষ্ট বেতন পেতেন। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবেন। বাবা সব ধরনের গাড়ি চালাতে পারেন।’

বাবার কষ্টের কথা উল্লেখ করে শোভন বলেন, ‘বাসের ইঞ্জিনের গরমে বাবার ড্রাইভিং করতে অনেক কষ্ট হয়ে যেত। সকালে বাবা ফ্রেশ চেহারা নিয়ে বের হলেও রাতে ফিরতেন বিধ্বস্ত হয়ে। এত কষ্ট করেও উপার্জন হতো খুবই কম, যা দিয়ে সংসার কোনো মতে চললেও আমার পড়াশোনা চলত না।

‘আমার ও-লেভেল পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল প্রায় ৬০ হাজার টাকার মতো। বাবা মাত্র ২০ হাজার টাকা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। আমি পরীক্ষা দিতে পারি নাই। বছরের পর বছর টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারি নাই।’

উবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শোভন বলেন, ‘বাবা উবারে গাড়ি চালানো শুরুর পর তার উপার্জন বেড়ে গেলে তখন বাবা বলেন, আব্বু তোমাকে আমি আবার পড়াতে চাই। একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন হলো ভর্তি হয়েছি।’

এরকম আরেক চালক আব্দুল মান্নান। এক মেয়ে, দুই ছেলে, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর এলাকায়। মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এক ছেলে বাংলা কলেজে। ছোট ছেলের বয়স ৬ মাস। পুরা সংসারের দায়িত্ব তার ঘাড়ে।

গাড়ির সামনে আব্দুল মান্নান। ছবি: নিউজবাংলা

আব্দুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে একটা অফিসে গাড়ি চালাতাম। এক বন্ধুর পরামর্শে আমি উবারে গাড়ি চালানো শুরু করি। আমার উপার্জন বেড়েছে। কোনো চিন্তা ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো উপার্জন করতে পারি। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারছি।’

তিনি বলেন, ‘যেখানে গাড়ি চালাতাম, সেখানে সকাল ৫টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত যেকোনো সময় গাড়ি চালাতে হতো। উবার চালাতে এসে নিজের খুশিমতো গাড়ি চালাই। আগে পরিবারকে সময় দিতে পারতাম না। এখন সারা দিন পরিবারকে সময় দেই। রাতে গাড়ি চালাই। নিজের এলাকা মানিকগঞ্জে ১৩ লাখ টাকার জায়গা কিনেছি। উবার চালিয়ে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে করতে কিস্তি প্রায় শেষ করে ফেলেছি।’

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘একবার উত্তরা কামারপাড়া এলাকায় এক মায়ের সন্তান প্রসবের আগে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে আসছিলাম। আরেকবার খিলগাঁও থেকে রাত ৩টার সময় আরেক ডেলিভারি রোগীকে নিয়ে গেছিলাম ঢাকা মেডিক্যালে। উবারের মাধ্যমে এ রকম অনেক উপকার করেছি মানুষের।’

এ বিভাগের আরো খবর