‘বাড়িতে কইসি হরচ কমাতে। নিজেরও অনেক কমায়া আনছি আগেত্তে। বাইরের বাড়তি হরচটা না করে চেষ্টা করতাসি এইডা সংসারে ঢালনের লাইগ্যা। সংসার নিয়ে এখন শুধু চিন্তা। কেমনে যে চলমু!’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা নাপিত মোহনলাল ঋষির। পাঁচ সদস্যের সংসারের খরচ মেটাতে তাই তিনি চিন্তা করছেন আয়বর্ধক আরও একটি কাজে যুক্ত হওয়ার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়া এলাকার জয়গুরু হেয়ার কাটিং নামে একটি সেলুনের মালিক মোহনলাল। বাড়িতে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। ১৪ বছর বয়সী বড় মেয়ে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ভাদুঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে আট বছর বয়সী ছোট ছেলেটি।
কেবল খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে এমন নয়, বাড়ছে গাড়ি ভাড়াও। শহরের কাউতলী এলাকার বাড়ি থেকে টিএ রোড কাজী মাহমুদ শাহ গেটের সামনে পর্যন্ত কর্মস্থলে অটোরিকশায় ভাগাভাগি করে যেতে যে ভাড়া ছিল ৫ টাকা, সেটি এখন ১০ টাকা।
যাওয়া-আসায় আগে লাগত ১০ টাকা, এখন লাগছে ২০ টাকা। অর্থাৎ মাসে এই খাতেও বেড়েছে ৩০০ টাকা। সেলুনের প্রত্যেকটি সামগ্রীর দামও বেড়েছে। তবে কিন্তু চুল-দাড়ি কাটার বিল বাড়ানো হয়নি এক টাকাও।
তাই দিন শেষে খরচ ও লাভের হিসাব করে সেলুনে থাকা কারিগরের বেতন দিয়ে থাকছে ৩০০-৪০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে খাবার খরচ হয়ে গেলেও মায়ের ওষুধ, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলসহ অন্যান্য খরচ মেটানো যাচ্ছে না।
মোহনলাল বলেন, ‘আমার প্রত্যেক মাসের ইনকাম ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এখন সংসার চালাতে দরকার ২০ হাজার টাকা। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বাড়তি। সংসারের খরচ ও মাইয়্যা-ছেলেডার পড়ার খরচও বাড়ছে। তাই অহন আর এক কাম করলে অইত না। আরেকটা কাজের চিন্তা করতাছি। সেলুনের কাজের লগে ওইডাও চালামু।’
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্যে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়, ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণসহ এমন কোনো পণ্য নেই যেগুলোর দাম বাড়েনি। এতে মোহনলালের মতো স্বল্প আয়ের মানুষদের সংসার চালানো হয়ে গেছে কঠিন।
রিকশাচালক আলী আজগর বলেন, ‘বউরে কইছি আবদার কমাইতে। এখন সংসারে তারা আগের চেয়ে খাওন অনেক কমাইছে। নিজের খরচ অনেকটা কমাই দিসি। আগে দিনে পাঁচটা সিগারেট খাইতাম, এখন দুটা খাই। আগে ১০ ঘণ্টা রিকশা চালাতাম। অহন ১৪-১৫ ঘণ্টা চালাই। দিন ফুরাইলে ঘরে বাজর তো কইরা দিতে হইব।’
সদর উপজেলার দারমা গ্রামে থাকেন তিনি। বাড়িতে মা আনোয়ারা খাতুন, স্ত্রী সাফিয়া বেগম ও তিন সন্তান রয়েছে। বড় সন্তান সাইফুল ইসলাম পঞ্চম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে সায়মন মিয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ৯ মাসের ছোট মেয়ে সাহেদসহ তাদের সবার দায়িত্বও আজগরের ওপর।
রিকশার মালিককে জমা দিতে হয় ৩৫০ টাকা। তারপর প্রতিনিয়ত এটা-ওইটা নষ্ট হওয়ায় এর জন্য খরচ আছে।
তিনি জানান, আগে সকাল ৮টায় বের হয়ে বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৮-৯ ঘণ্টা রিকশা চালাতেন। তখন দিনে ৬০০-৭০০ টাকা রোজগার হতো। রিকশা ভাড়া বাবদ মালিককে ৩০০ টাকা দিতেন। বাকি টাকা হাতে থাকত। এখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা পর্যন্ত রিকশা চালান বাড়তি আয়ের আশায়।
আজগর বলেন, ‘মালিক রিকশার ভাড়া বাড়াইছে। তার ওপর বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। গ্রামের সংসারের খরচ ও দুইটা ছেলের পড়ার খরচও বাড়ছে। তাই অহন আগের তুলনায় আরও ৪-৫ ঘণ্টা বেশি রিকশা চালাই। এইড্যা ছাড়া কোনো উফায় (উপায়) নাই।
‘কোমরে ব্যথা হইয়া গেছে। কিন্তু বাঁচতে তো অইব। ঘরে বউ, পুলা-মাইয়্যা ও মা আছে। আমি রুজি না করলে খাইব কী?’