নদীর নাম গড়াই। একদিকে রাজবাড়ী জেলা, অন্যদিকে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মহেশপুর গ্রাম। তবে এ পারে মহেশপুর গ্রামেও রাজবাড়ী জেলার কিছু অংশ আছে। নদীভাঙনের ফলে এমন হয়েছে।
এই ভৌগোলিক খামখেয়ালি সুযোগ করে দিয়েছে একদল বিকাশ প্রতারক চক্রকে। নদীর পারে ধান ও পাট ক্ষেত আর উঁচু বালুর ঢিবিতে তারা গড়ে তুলেছে তাদের ‘অফিস’।
সারি সারি মোবাইল নিয়ে তারা বসে পড়ছে এসব ‘অফিসে’। কল করছে দেশের নানা প্রান্তে। ফাঁদে ফেলছে বিকাশ কিংবা আর্থিক সেবা দেয়া কোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের।
‘আপনার মোবাইলে টাকা গেছে’ অথবা ‘আপনার পিন কোডটি আমাদের বলুন’– এসব বলে তারা সূচনা করছে ডিজিটাল ধাপ্পাবাজির। এ অঞ্চলের শতাধিক যুবক জড়িয়ে পড়েছে এসব প্রতারণা চক্রে। গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে এসব প্রতারকচক্র অল্পদিনেই পাকা বাড়িঘরসহ বিলাসবহল গাড়ির মালিক হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মহেশপুর গ্রামঘেঁষে বয়ে যাওয়া গড়াই নদী
মাগুরা জেলা সদর থেকে শ্রীপুর উপজেলা ১৪ কিলোমিটার। আর শ্রীপুর থেকে আরও সাত কিলোমিটার গেলে দরিয়াপুর ইউনিয়ন। এরপরই মহেশপুর গ্রাম।
গ্রামটির একটা অংশ গড়াই নদী ঘেঁষে। এখানে বেশির ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অল্প কিছু মানুষ সরকারি চাকরি করেন। নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবে গ্রামটির নদীর চরাঞ্চলে গেলে খটকা লাগবে। এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা যেন হঠাৎ করে ঘুরে গেছে। টিনের ভাঙা ঘরগুলো মাত্র এক বছরে হয়ে গেছে পাকা দালান। চলছে দোতলার কাজ। দামি মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন বেশ কিছু উঠতি যুবক, যাদের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছর।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব দালানবাড়ি কেমন করে হলো তাদের জানা নেই। তবে এসব বাড়ির ছেলেরা কাজ করে। সেই কাজ হলো মোবাইলে টাকা আনে। নদীর পারে তাদের ‘অফিস’। এরা উঠতি বয়সী হলেও যারা এদের নেতৃত্ব দেয়, তাদের বয়স ৩০-এর কাছাকাছি। গ্রামের লোকেরা বলেন, ‘এরা বসে বসে কথা কয়, আর টাকা চলে আসে।’
স্থানীয়রা জানেন, অন্যের মোবাইলের টাকা এরা হতিয়ে নিচ্ছেন। তবে বিষয়টা নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না। প্রাণনাশের হুমকিসহ নানা ভয়ভীতি দেখায় প্রতারকচক্র।
মাগুরা গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র মতে, প্রতারকচক্রের দুটি গ্রুপ আছে মহেশপুর ও চর মহেশপুর গ্রামে। স্থানীয়রা এটার নাম দিয়েছে ‘টোপ মারা’। আর যারা জড়িত, তারা ‘টোপ পার্টি’ নামে পরিচিত। প্রতারণায় জড়িত শতাধিক তরুণ। যাদের বাড়ি একই এলাকায়। প্রতারকরা পুলিশের নজরদারিতে আছে।
মহেশপুর গ্রামের টিনের ভাঙা ঘরগুলো মাত্র এক বছরে হয়ে গেছে পাকা দালান
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, প্রতারকচক্র এ গ্রাম থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী গ্রামেও। মহেশপুর থেকে গোয়ালদহ, চর গোয়ালদহ, চর মহেশপুর, চৌগাছী, চর চৌগাছী, ঘষিয়াল, শ্রীকোল ইউনিয়নের বরিশাট গ্রাম এবং নয়নশার ঘাট এলাকায়ও অর্ধশতাধিক তরুণ এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে বলে তথ্য আছে।
মহেশপুর গ্রামের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২৫০ সিসি ইঞ্জিনের ৫ লাখ টাকা দামের মোটরসাইকেল চালাচ্ছে এখানকার কলেজপড়ুয়া ছেলেপেলে, যাদের পরিবারের আয় অত্যন্ত কম, পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
ওই ব্যবসায়ী জানান, দামি মোটরসাইকেল কিনে এরা সারা গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। কারণ প্রায় প্রতিটি বাড়ির কেউ না কেউ এতে জড়িত। আবার যারা গ্রামের সচেতন ব্যক্তি, তারা ভয়ে মুখ খুলছে না।
তিনি আরও জানান, এদের প্রতারণায় নিয়োজিত কর্মীদের একাধিক গ্রুপ। প্রথম গ্রুপটির কাজ বিকাশ, নগদ, রকেট কিংবা অন্য মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট পর্যায়ে ঘোরাঘুরি করে তথ্য সরবরাহ করা। এজেন্টের কাছে যেসব গ্রাহক টাকা পাঠান, তাদের তথ্য এজেন্টরা ছবি তুলে দিয়ে দেন প্রথম পর্যায়ের কর্মীদের হাতে।
এরপর যাদের নামে অর্থ আসে, তাদের কাছে ফোন দেয় আরেকটি গ্রুপ। এরা নির্জন জায়গায় এ কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে মহেশপুর চরাঞ্চল উপযোগী জায়গা। এ জন্য রাজবাড়ী এলাকা থেকে চক্রের সদস্যরা নৌকাযোগে মহেশপুর চরে আসে।
মোবাইল ব্যাংকিং-এর গ্রাহক যারা টাকা পায়, তাদেরই মূলত এরা টার্গেট করে নানা ফাঁদ পাতে। ১০ জনের মধ্যে একজন টোপে (ফাঁদে) পা দিলেই এরা সফল। কারণ দিনে শতাধিক মানুষকে এরা ফাঁদে ফেলে।
এই মোড়ের দোকানগুলোতে আড্ডা দিতে দেখা যায় ওই যুবকদের
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, এই প্রতারণায় শতাধিক কিশোর ও তরুণ জড়িত থাকলেও এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তিন-চার জন। এদের সঙ্গে ৩০ থেকে ৪০ জন তরুণ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। চক্র আকারে এরা ছড়িয়ে পড়েছে মাগুরা জেলার নানা প্রান্তে।
ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারে- এমন শঙ্কায় এদের নাম-ঠিকানা সরাসরি প্রকাশ করছে না পুলিশ।
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে মহেশপুরে এ রকম একটি গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা একজনের বাড়িতে যাওয়া হয়। বুধবার বিকেল ৩টায় তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। বারবার মোবাইলে কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তরুণের বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ছাদে কাপড় শুকাতে দেখা গেলেও বাড়িটি ফাঁকা পাওয়া যায়।
প্রতিবেশীরা জানান, তারা সকালেও ছিল। এখন কেউ নাই।
এই গ্রুপ প্রধান কী করেন, জানতে চাইলে প্রতিবেশীরা কিছু জানেন না বলে জানান।
২০২০ সালের ৩০ আগস্ট শ্রীপুর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়। এতে ১০ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে বলা হয়, অভিযুক্তরা দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি হ্যাক করছে এবং বিকাশ কোম্পানির গ্রাহকের টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে শ্রীপুর থানা পুলিশ উদ্ধার করে ৯টি কম্পিউটার, ১০টি মোবাইল ফোনসেট, সাতটি হার্ডডিস্ক ও একটি ইন্টারনেট মডেম।
মামলার পরই প্রতারকচক্র সতর্ক হয়ে যায়। মামলাটি এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
পুলিশ বলছে, মহেশপুর এলাকাটির ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছে প্রতারকচক্র। মাগুরা, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার সীমানা হওয়ায় এ এলাকায় থানার পুলিশের নজরদারি কম থাকে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন দপ্তর থেকে মোবাইলে প্রতারণার অভিযোগ আসে। তবে তা দেশের নানা প্রান্তে ঘটায় শ্রীপুর থানায় কেউ মামলা দিতে আসে না। এ জন্য প্রতারকচক্র বরাবর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
দরিয়াপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান আব্দুর সবুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মহেশপুর এলাকায় একবার গিয়েছি চরাঞ্চলে নদীভাঙন দেখতে। কিন্তু চরে মনে হলো কিছু যুবকের হাট বসেছে। তাদের কাছে অনেক মোবাইল দেখেছি। তারা কথা বলছিল। পরে শুনেছি, এরা নানা অপকর্মে জড়িত। বিকাশের টাকা এরা হাতিয়ে নেয় বলে শুনেছি।
‘উপজেলার আইনশৃঙ্খলা সভায় এটা আমি তুলেছি। প্রশাসন বলেছে, তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। আমি চাই বিপথগামী তরুণরা সঠিক পথে আসুক। এসব প্রতারণার কোনো প্রমাণ হাতেনাতে যদিও আমি পাইনি, তবু যদি এটা প্রমাণিত হয়, তবে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা প্রিটন সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখানে মে মাসে এসেছি। এলাকায় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। বিকাশ প্রতারকচক্রের তথ্য আমি পেয়েছি। স্থানীয়রা যদি সহযোগিতা করে, তবে এদের নির্মূল করা সম্ভব। পুলিশের পক্ষ থেকে শতভাগ চেষ্টা আছে এদের প্রতিরোধ করার। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা কাজ করছি।’