রংপুরের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া হাঁড়িভাঙা আমে এবার কম ফলন হয়েছে। চাষিরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে এত কম ফলন দেখেননি তারা।
কী কারণে গাছে আমের ফলন কম, তা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও প্রতি বছর আমগাছে নিষিদ্ধ ‘কালটার্ন’ নামক হরমোন প্রয়োগে এমনটা হতে পারে বলে ধারণা কৃষিসংশ্লিষ্টদের।
সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের আখিরাহাট, লালপুর, রুপসি, গাছুয়াপাড়া, মাঠের হাট, লালপুকুর, পদাগঞ্জহাট, পাইকারহাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছোট-বড় সব আমগাছেই গুটি এসেছে। তবে প্রতিটি গাছে যে পরিমাণ আমের গুটি রয়েছে, তা অন্যান্য বছরের চেয়ে অর্ধেক।
স্থানীয় আমবাগান মালিক ও চাষিদের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেপারিরা বাগান কিনছেন। তাদের বাগানের আমের আকার বড়, দেখতেও সুন্দর। তাদের দেখে রংপুরের আমবাগান মালিক এবং বাগান কেনা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা গাছের গোড়ায় হরমোন দিয়েছেন।
এ ছাড়া গাছে দিয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক। এর প্রভাবও পড়তে পারে।
একশ্রেণির কীটনাশক ব্যবসায়ী এই হরমোন গোপনে বিক্রি করছেন। চাষিরা দোকান থেকে কিনে তা গাছে প্রয়োগ করেছেন।
খোড়াগাছের জারুল্লাপুর গ্রামের আমবাগান মালিক মাহসিন আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী এক বা দুই বছরের জন্য আমবাগান ইজারা নেন, তাদের অনেকেই বেশি আম পাওয়ার লোভে গোপনে এই হরমোন ব্যবহার করছেন।
‘বছর দুয়েক আগে থেকে আমাদের এলাকার অনেকেই তাদের গাছে হরমোন ব্যবহার করেছেন। গাছের গোড়া খুঁড়ে ওষুধ দিয়েছেন। এতে আমের সাইজ বড় হয়েছে, কিন্তু এবার কম ধরেছে।’
মিঠাপুকুরের আখিরাহাটের আমবাগান মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বেপারিরা এসে বাগান লিজ নেয়, তারপর মেলা ওষুধ দেয়, হরমোন দেয়। তাতে গাছের ক্ষতি তো আসবে, অবশ্যই আসবে। এবার কম আসছে, দুই-চার বছর পর হয়তো আম নাও ধরতে পারে।’
খোড়াগাছের লালপুর গ্রামের নুর ইসলাম বলেন, ‘আমার ৫০ শতকের তিনটা বাগান আছে। ফলন কম হইছে। মানে, ফুল খুব আসছে কিন্তু আম টেকে নাই। আমরা বাগান মালিকরা ভয়ে আছি, ভবিষ্যতে বাগানের যে কী অবস্থা হবে, গাছের কী হবে, আম ধরবে কি না?’
লালপুর গ্রামের আমচাষি আবু বক্কর বলেন, ‘আমগাছের বৈশিষ্ট্য হলো এক বছর বেশি ফলন হলে পরের বছর তুলনামূলক কম হয়। গাছ তার স্বাভাবিক নিয়মে দীর্ঘমেয়াদে ফল দেয়। আমরা অনেকেই হরমোন দিই নাই। যারা দেই নাই, তাদের বাগানে আবার ভালো আম আছে।’
‘আমাদের এলাকায় অন্য আবাদ নাই। আমরা সর্বস্ব বিনিয়োগ করে আমের বাগান করি। আমবাগানের ওপর আমাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। ব্যবসায়ীরা এসে সেই গাছের ওপর হরমোন প্রয়োগ করে অত্যাচার করছে। এতে আমরা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কায় আছি।’
খোড়াগাছ এলাকার জারুল্লাপুরে চারটি বাগান কিনেছেন রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় আট বছর থেকে আমি বাগান কিনি। এবারও কিনছি। প্রতিটি বাগানে যখন ফুল আসে, তখনই কেনা হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়।
‘যখন গাছে ফুল আসে তখন গাছের গোড়া খুঁড়ে একবার হরমোন দিছি। এরপর দুবার কীটনাশক দিছি। বছরে একবার করে হরমোন আর তিন থেকে চারবার করে কীটনাশক দিলে আম ভালো ধরে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসে হাঁড়িভাঙার বাগান কেনা শহিদুল্লাহ শহীদ বলেন, ‘আমরা কখনও হরমোন দিই না। যখন মকুল আসে তখন কীটনাশক এবং পরে ভিটামিন দিই। অনেকেই আমাদের বিরুদ্ধে ব্লেম (অভিযোগ) দিচ্ছে বলে শুনতেছি, এটা না জেনে বলা ঠিক না।’
তদারকির অভাব কৃষি বিভাগের
রংপুর মেট্রোপলিটনসহ জেলার আটটি উপজেলায় এবার হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে এবার আমের আবাদ হয়েছে।
এর মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় ২৫ হেক্টর, রংপুর সদর উপজেলায় ৬০, কাউনিয়া উপজেলায় ১০, গঙ্গাচড়া উপজেলায় ৩৭, মিঠাপুকুর উপজেলায় ১ হাজার ২৭০, পীরগঞ্জ উপজেলায় ৬০, পীরগাছায় ১০, বদরগঞ্জে ৪০০ এবং তারাগঞ্জে ১৫ হেক্টর রয়েছে।
আমবাগান চাষি এবং মালিকদের অভিযোগ, আমচাষিদের এমন দুর্দিনে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। আমগাছের অবস্থা এবং পোকার ধরন দেখে দোকান থেকে ওষুধ এনে ছিটানো হচ্ছে।
রুপসি গাছুয়াপাড়া গ্রামের চাষি নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এক বিঘা জমিত আমার বাগান আছে। যখন ফুল (মুকুল) আসছে, তখন একবার গাছোত হরমোন দিছি। তারপর কিছুদিন পর পোকার মতো ধরছে, পরে দোকান থাকি কীটনাশক আনি দিছি। একনা কমছে। ফের দেমো।’
এমন অন্তত ১০ চাষির সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। সবার প্রায় একই অভিযোগ, মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সময়মতো পাওয়া যায় না।
কীটনাশক দোকানই ভরসা চাষিদের
মাঠের হাটের সুলতান আলী নামে আমবাগানি বলেন, ‘গাছ এবার সকসকা (আম নাই)। যেলা মইল (মুকুল) আসিল খোকনের দোকান থাকি ওষুধ আনি দিল, কিছু হইল নে। যামরা যামরা (যারা যারা) সাদা ওষুধটা দিছে তার বাগানোত কিছু কিছু আম টেকছে (টিকছে)।
‘হামার গাছের ডাল একবারে সকসকা। কিছুই নাই। এত টেকা-পইসে খরচ করনো, সোউগ পানিত ভাসি গেইছে। আর বাগান বেইচপের নই। নিজে থাকি আবাদ করমো।’
মিঠাপুকুরের এরশাদ মোড় এলাকার কীটনাশক বিক্রেতা আখেরুজ্জাম রাজা বলেন, ‘বর্তমানে ফ্লোরা, বায়োফার্টি, কমপ্লেসান সুপার, পিজিআর এগুলাই বেশি ইউজ হচ্ছে। বোতলের গায়ে মাত্রা দেয়া আছে। যে নির্দেশনা দেয়া আছে, সে অনুযায়ী দিতে বলি। অনেক ক্ষেত্রে চাষিরা ওদের প্রয়োজন মতো নেয়। ওরা দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জানে এই পরিমাণ দিতে হবে, সে অনুযায়ী নেয়।
‘এ ছাড়া মাঝে মাঝে কৃষি অফিসের বিএসরা (উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা) আসে বসে, তারাও পরামর্শ দেয়। আমি হরমোন বিক্রি করি না। আমার দোকানে হরমোন নেই।’
আরেক কীটনাশক বিক্রেতা আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার বলেন, ‘হরমোন তো আমাদের কাছে নেই, আছে ভিটামিন। কৃষকরা এসে নাম ধরে চায় আমরা দিই। ওরা ওদের মতো করে ভিটামিন ও কীটনাশক ব্যবহার করে।’
কী বলছে কৃষি বিভাগ
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সংবাদ এসেছে গোপনে আমে হরমোন ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কালটার্ন নামে হরমোন ব্যবহার করছেন আমের আকার বড় করার জন্য। তারা হয়তো তাৎক্ষণিক সুফল পাবেন, কিন্তু কালটার্ন হরমোন ব্যবহারে গাছের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয়।’
কৃষি কর্মকর্তাদের না পাওয়ার অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাঁড়িভাঙা আমের মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করতে হরমোন প্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এই হরমোন যেন আম ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে উঠান বৈঠক, মাঠ বৈঠক করা হচ্ছে। তবে আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কোনো ওষুধের দোকানে এ হরমোন পাননি। শুনেছি এটি ভারত থেকে চোরাইপথে আসে। গোপনে বিক্রি হতে পারে। এ জন্য চাষিদের সজাগ থাকতে হবে।’
‘এই হরমোন নিয়ে আমাদের গবেষণা চলছে। আমরা খুব নিকট ভবিষ্যতে এই হরমোনের ফলাফলটা জানতে পারব’, যোগ করেন ওবায়দুর।
তিনি আরও বলেন, ‘কখনও কখনও গাছে একবার ভালো ফলন হলে অন্যবার কম হয়। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। সেটা এবার হয়েছে কি না সে জন্য আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
হরমোন নিয়ে কী বলছেন বিজ্ঞানীরা
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আট-দশ বছরের বেশি সময় ধরে এই হরমোনের ব্যবহার হচ্ছে। এতে যেটা সমস্যা হয়, প্রচুর পরিমাণে মকুল আসে। প্রচুর আম হয়। পাতা কম বের হয় শুধু আমই চলে আসে।
‘কৃষকরা এটা গোপনে গোপনে ব্যবহার করেন। এরপর ধীরে ধীরে গাছের শক্তি কমে যায়। যে কারণে আমের উৎপাদন বা আম কম ধরে। এমনকি ঠিকমতো গাছকে খাবার না দিলে গাছ মরে যায়। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বিভিন্ন এলাকায় গাছ মরেও গেছে।’
ড. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে খুব প্রেসারক্রিয়েট করেছি, যাতে এটা কেউ ব্যবহার না করে। রাতে এটা ব্যবহার করায় বহু চাপাচাপি করেও ঠেকানো যায় না। এখন এটা সরকারিভাবে অনুমোদ দেয়া হয়েছে। তবে মাত্রা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে হবে। মাত্রা বেশি হলে সমস্যা হয়।
‘এই হরমোন ব্যবহার করলে গাছকে প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য খাবার দিতে হবে। একবার ব্যবহার করলে পরের তিন বছর ব্যবহার করা যায় না, যাবেও না।’
রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক ও চাষি আব্দুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাগানে হরমোন ব্যবহারের অভিযোগ কিছুদিন ধরে শুনতেছি। আমি প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে অনুরোধ করব। এই আম প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। অনেক সুনাম রয়েছে। ধীরে ধীরে এই আমকে নষ্ট করা যাবে না।’