সরকারি প্রতিষ্ঠান কতটা লাভজনক সেটাকে বড় করে দেখতে চান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ কতটা সেবা পেল, জীবনমান কতটা উন্নত ও সহজ হলো সেটাই মুখ্য মনে করেন তিনি।
তাই বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি পরামর্শকদের কথা শুনে বিএনপি সরকার বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিটিআরসি) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে চাইলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা করেনি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে বুধবার সকালে মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর এবং ৪৬টি লোকোমোটিভের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের মানুষের সেবা করাটাই হচ্ছে আমাদের কাজ। যে কারণে বিআরটিসি একসময় বলা হয়েছিল বন্ধ করে দেয়া হবে, কারণ ওটা লাভজনক না। সরকারি প্রতিষ্ঠান কতটুকু লাভ করল বা কতটুকু লাভ করল না সেটার থেকে বড় কথা, মানুষের সেবা কতটুকু দিতে পারল। মানুষ কতটুকু সেবা পেল। মানুষের জীবনমান কতটা সহজ হলো। সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা।’
আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করলে সব প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব জায়গায় সব কিছু যে লাভবান হবে, সেটা না। কিন্তু লাভবান করা যায়। আমরা বিআরটিসিকেও যেমন লাভবান করেছি, আজকে রেল যেটাকে অলাভজনক বলে বন্ধ করতে বলা হয়েছিল এবং বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি সরকার, আজকে সেটা চালু করে এটাও প্রমাণ করেছি রেলকেও লাভবান করা যেতে পারে এবং করা যায়। রেল আজকে লাভবান প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
রেল খাতে জনবলের অভাব রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই লোকবল আমাদের বাড়াতে হবে। তার জন্য ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটা দ্রুত কার্যকর করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এখানে লোকবল আরও ভালোভাবে দিতে পারলে পরে লাইনগুলো আরও সম্প্রসারিত হবে এবং নতুন নতুন যে লাইনগুলো তৈরি করছি, সেগুলো চালু হয়ে গেলে আমি মনে করি এটা আরও লাভবান হবে।’
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় রেলকে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বিআরটিসি বন্ধ করার পরিকল্পনা, রেল বন্ধ করার পরিকল্পনা- এসব কিছুর পরামর্শ দিয়েছিল কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রেলের ১০ হাজার কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অনেক রেললাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। রেল আসলে মুখ থুবড়ে পড়ে।’
রেল খাতের উন্নয়নে ২০১১ সালে রেল মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে বলে জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমরা সারা বাংলাদেশে রেল যোগাযোগকে আরও বর্ধিত করা, যে সমস্ত অঞ্চলে রেল নেই সেখানেও রেল লাইন নিয়ে যাওয়া এবং রেলের ব্যাপক সম্প্রসারণে পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। যার ফলে আজকে যে কোন দুর্যোগেও রেল আমাদের মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।’
দেশের মানুষের যাতায়াত সুগম করার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনকে সহজ করতে চান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একেক অঞ্চলে অনেক পণ্য উৎপাদন হয়। সেগুলো সহজলভ্য করে দেয়া। বাজার তৈরির সুযোগ করে দেয়া। যাতে আমাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত হবে এবং আমাদের মানুষ লাভবান হবে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা সেই পদক্ষেপ নিয়েছি।’
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে নৌ, সড়ক, আকাশপথের চেয়ে রেলপথকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তিনি। বলেন, ‘রেল এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সব থেকে বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারে রেল। আবার মানুষ যাতায়াত করতে পারে রেলে অল্প খরচে।’
‘আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করেছিল বিএনপি’
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মর্যাদা ধরে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে মাঝে মাঝে বিপত্তি আসে। এটা হচ্ছে দুঃখজনক।’
২০১৩-১৪ সালের বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের নামে সহিংসতার সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘যখন আমরা নতুন নতুন কোচ কিনলাম, আমরা নতুন নতুন লোকোমোটিভ কিনলাম, ইঞ্জিন কিনলাম সেই সময় বিএনপি শুরু করল অগ্নিসন্ত্রাস। সব থেকে দুঃখজনক এই যে নতুন রেলগুলো যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে, সেই রেলে আগুন দেয়া হলো।…রেল লাইন, রেল কোচ, ইঞ্জিন বিএনপি পুড়িয়ে দিয়েছিল। এটা নাকি তাদের আন্দোলন!’
আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি জানিনা মানুষকে পুড়িয়ে মারা বা চলন্ত বাস, গাড়ি অথবা রেলে আগুন দিয়ে, লঞ্চে আগুন দিয়ে, এটা কোন ধরনের আন্দোলন। এটাতো এক ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।’
বিএনপি দেশের মানুষের কল্যাণে কখনও কিছু করেনি বলেও জানান সরকারপ্রধান। নিজের কথার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘তারা তো ক্ষমতা দখলকারীদের হাতে ক্ষমতায় বসে প্রতিষ্ঠিত পার্টি। জনগণের মধ্যে থেকে তো উঠে আসেনি। কাজেই জনগণের কল্যাণের দিকে তাদের দৃষ্টি থাকে না। ক্ষমতার লোভটাই তাদের বড়। কারণ মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, বাংলা ভাই সৃষ্টি, এগুলোই তো তাদের কাজ ছিল। তারা তো দেশের মানুষের কল্যাণে কিছু করেনি।’
রেল যাবে পায়রা বন্দরে
বরিশাল বিভাগের ১৮টি উপজেলাকে সংযুক্ত করে পায়রার বন্দর পর্যন্ত একটি রেল লাইন নির্মাণে অ্যালাইনমেন্ট করা হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘এটার ফিজিবিলিটি এখনও স্টাডি হচ্ছে, সেখানে রেল লাইন কিভাবে স্থাপন করা যায়।’
এটি হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, যে অঞ্চলের মানুষ জলবায়ুর অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যাচ্ছে, সেখানে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে থেকে ওই অঞ্চলের মানুষ যাতে রক্ষা পায়। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা যাতে সুগম হয়। আমরা নদীগুলোর ড্রেজিং করে নৌপথ সচল করে দিচ্ছি।’
অনেক অঞ্চলে রেল লাইন নির্মাণে প্রতিবন্ধকতার দিকটিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দেখতে হবে যে, আমাদের নদী নালা খাল-বিলের দেশ। আমাদের মাটি অনেক নরম। সেটা বিবেচনা করে কতটা, কিভাবে কোন কোন জায়গায় রেল লাইন করা দরকার সেগুলো আমরা বিবেচনা করেছি।’
পদ্মা সেতুতে রেল যুক্ত করার প্রসঙ্গটি সামনে এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল লাইন যুক্ত করে যেমন ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ফরিদপুর হয় সেই রেল সংযোগ করে দিচ্ছি। যশোর থেকে খুলনা হয়ে একেবারে মংলা পোর্ট পর্যন্ত এ রেল লাইন সংযোগ স্থাপন হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুন্দর করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও সচল করা আরও উন্নত করা তারই পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর
একটি ব্রডগেজ ও একটি মিটারগেজ কোচ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর।
এটি নির্মাণ করায় রেল মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার যে অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বা বাঙালি জাতির জন্য সেটা আমাদের দেশের মানুষ আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপিরবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ইতিহাস আপন গতিতে ফিরে আসে। ইতিহাসকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না এবং সেটাই আজ প্রমাণিত সত্য আজকে শুধু বাংলাদেশ না সারা বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার অবদান এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের স্থান পেয়েছে।’
রেল বহরে যুক্ত হলো লোকোমোটিভ
উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সংগ্রহ করা ৩০টি মিটারগেজ ও ১৬টি ব্রডগেজ লোকোমেটিভেরও উদ্বোধন ঘোষণা করেন সরকারপ্রধান।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কদিন পরে ঈদ। ঈদে লোক চলাচল আরও বৃদ্ধি পাবে। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আজকে যে নতুন লোকোমোটিভ চালু হতে যাচ্ছে তাতে আমাদের দেশের মানুষ আরও ভালোভাবে ঈদের উৎসবে যোগ দিতে পারবেন, নিজের আপন ঘরে ফিরতে পারবেন, সেই সুবিধাটা হবে।’