বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অকার্যকর হয়ে পড়েছে বাঁশখালী বেড়িবাঁধ

  • রহিম সৈকত, আনোয়ারা ও বাঁশখালী (চট্টগ্রাম)   
  • ১ জুন, ২০২৫ ১৬:৩৫

চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালী। বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে বিস্তৃত এই জনপদের একমাত্র ঢাল হিসেবে কাজ করে বেড়িবাঁধ। কিন্তু বছরের পর বছর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নিম্নমানের নির্মাণকাজে সেই ঢাল আজ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। লক্ষাধিক মানুষ এখন প্রকৃতির করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে, কারণ যেকোনো সময় একটুখানি জলোচ্ছ্বাসেই ভেসে যেতে পারে তাদের ঘরবাড়ি, চাষের জমি আর স্বপ্ন।

চলমান বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া ও প্রচণ্ড ঢেউয়ের ফলে বেড়িবাঁধ ভাঙা অংশ দিয়ে বানের জলের মতো হু-হু করে পানি প্রবেশ করছে। শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। বিপরীতে এসব দেখে অসহায় অবস্থায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে উপকূলবাসীর।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। পরবর্তী সময় ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হলেও, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে কদমরসুল, খানখানাবাদ, প্রেমাশিয়া, সাধনপুরসহ একাধিক পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমস্যা শুধু কাজের মানে নয়, প্রকল্প নকশাতেও। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিউন বাসির বলেন, ‘এ ধরনের ব্যর্থতার পেছনে দুটি বড় কারণ- নিম্নমানের নির্মাণ ও নকশাগত ত্রুটি।’

তিনি আরও বলেন, যদি সঠিক নকশা অনুসরণ করে টেকসই উপকরণ ব্যবহৃত হতো, তাহলে এই পরিণতি আসার কথা ছিল না।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আজও বাঁশখালীবাসীর মনে তাজা। সেদিন শুধু বাঁশখালীতেই প্রাণ হারিয়েছিল ৩৫ হাজার মানুষ। সেই স্মৃতিতে প্রতিবছর এপ্রিল মাস এলেই নতুন আতঙ্কে ভোগেন উপকূলবাসী। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়, কারণ চলমান ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে আবারও বেড়িবাঁধ উপচে সাগরের পানি গ্রামে ঢুকে পড়ছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক জনপ্রতিনিধিরা। একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ। এমনকি অনেকে বলছেন, প্রকল্পের অর্ধেক টাকাও ব্যয়ে যায়নি, বাকিটা গেছে ভাগ-বাঁটোয়ারায়।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘যে এমপি ছিলেন, তিনিও ভাগ পেতেন, ইউপি চেয়ারম্যানরা মাল সরবরাহ করতেন, সব মিলিয়ে বাঁধের এই অবস্থা।’ এই বাঁধের নির্মাণে কাজ পেয়েছে পূর্বে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ‘হাসান ব্রাদার্স’-এর মতো সংস্থাও, বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় অধিবাসী ও মেরিনার ক্যাপ্টেন মনজুরুল হক টেকসই আধুনিক বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসী যখন অসহায়, তখন বহিরাগত গোষ্ঠী উৎসবের মতো করে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ লুটছে। এদের কোনো স্থানীয় দায়বদ্ধতা নেই, অথচ তারাই এখন প্রধান সুবিধাভোগী। জেলেদের অভিযোগ, প্রভাবশালীরা নিষিদ্ধ জাল ও আধুনিক ট্রলার দিয়ে মাছের ডিম ও ছোট মাছ পর্যন্ত ধরে ফেলছে, ফলে মাছের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে এবং স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরা কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব কার্যকলাপ সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনছে।

ঠিকাদার ব্যবসায় জড়িত একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার বলেন, দুর্নীতি শুধু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে হয়, ঠিকাদারদের হাতে হয় তেমন নয়, এই কাজে যে সরকারি দপ্তরও জড়িত আছে, পার্সেন্টেস ছাড়া যে ফাইল নড়াচড়া হয় না এই খবর কয়জনে রাখে। টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার জন্য পছন্দের লোকজনদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার খবর কেউ বলে না। ধাপে ধাপে পার্সেন্টেসের খেলা বন্ধ করা গেলে কাজের কাজ কিছু হবে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের মে মাসে নতুন করে বাঁশখালী বেড়িবাঁধ উন্নয়নে ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছিল একনেক সভায়। সচেতন মহলের দাবি বড় বাজেট মানেই টেকসই কাজ নয়। যদি তদারকি না থাকে, দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে রক্ষা না করা যায়, তাহলে ৬০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পও অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি দুর্নীতির দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয়দের দাবি সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর অধীনে নির্মাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। তৃতীয় পক্ষ দিয়ে নির্মাণসামগ্রী, ব্যয় ও অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রকল্প মনিটরিং বাড়াতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী উপ-প্রকৌশলী তানজির সাইফ বলেন, ইতোমধ্যে মোট পাঁচ প্যাকেজে পাঁচটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বিধিমোতাবেক চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। বাঁশখালীর অভ্যন্তরীণ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী বিদায় সাগরপথে মালামাল আনা হবে তার জন্য জেটি নির্মাণ করতে হবে। বেড়িবাঁধের বেহালদশার কথা বলা হলে তিনি বলেন কিছু হবে না। গত বছর কিছু হয়েছিল? এর মধ্যে আমাদের কাজ শুরু হবে।

বাঁশখালীর বেড়িবাঁধ আজ শুধু একটি প্রকৌশলগত কাঠামো নয়, এটি লক্ষাধিক মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কেবল একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জনগণের প্রতি কর্তব্য পালনের একটি পরীক্ষা।

ক্যাপশন:

১. সাগরের পানি বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় বিরান হওয়ার পথে।

এ বিভাগের আরো খবর