জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বহন করছে, বাংলাদেশ সেগুলোর একটি। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমাগত বাড়ছে। এসব দুর্যোগে জীবন ও সম্পদহানি এড়াতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রধান সহায়।
বাংলাদেশে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। চলছে প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন।
এমনই বাস্তবতায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বুধবার ২৩ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া দিবস।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কর্মকাণ্ড অনেক পুরোনো। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনটি বসেছিল ১৮৭৩ সালে ভিয়েনায়। সেখানেই গঠন করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা। ১৯৫০ সালের ২৩ মার্চ প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)।
আবহাওয়া বিজ্ঞানের উন্নতি ও নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরালো করতে ১৯৫১ সাল থেকে ২৩ মার্চ বিশ্ব আবহাওয়া দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ১৯১টি সদস্য রাষ্ট্র দিনটি পালন করে।
এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আগাম সতর্কতা এবং আগাম পদক্ষেপ– দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে আবহাওয়া, পানি ও জলবায়ুর তথ্য’। বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির গুরুত্ব তুলে ধরা এবারের লক্ষ্য।
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফাইল ছবি
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি কৃষি, নগর পরিকল্পনা এবং জরুরি সেবাতেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রয়োজন হয়।
সারা বিশ্বে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আছে ১০ হাজারেরও বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব কেন্দ্র থেকে আবহাওয়া ও জলবায়ুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সদস্য দেশগুলোতে দ্রুত ও কম খরচে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে আবহাওয়াবিদদের দক্ষতা আরও বাড়ছে। রিমোট সেন্সিং ওয়েদার স্যাটেলাইট এ ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে জিও স্টেশনারি ওয়েদার স্যাটেলাইট বিশ্বের প্রতিটি স্থানকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে। এর ফলে মহাকাশ, বায়ুমণ্ডল, ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্র পর্যবেক্ষণসহ বিশ্ব আবহাওয়া ও জলবায়ুর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে।’
এ দেশে আবহাওয়াবিষয়ক যেকোনো ধরনের পূর্বাভাস পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরই একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। আর কোনো প্রতিষ্ঠান আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয় না। এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করে না।
বন্যা এবং নদী ব্যবস্থাপনায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে মনে করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান।
তিনি জানান, বিভিন্ন ধরনের আবহাওয়া পূর্বাভাস দিতে বর্তমানে সারা দেশে ৬১টি ভূপৃষ্ঠ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার, ২০টি কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার, পাঁচটি রাডার এবং স্যাটেলাইট রিসিভিং গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
পর্যবেক্ষণে পাওয়া উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংখ্যাগত মডেল পরিচালনা করে সমন্বিত আবহাওয়া পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে দেশে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়, রাজশাহী, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে স্থাপিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে দেশে এবং দেশের বাইরে যেকোনো স্থানে সংঘটিত ভূমিকম্পের তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভূমিকম্পের পর সমুদ্র উপকূলে সুনামির আশঙ্কা থাকলে সেই সতর্কতাও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়।
দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস গুরুত্বপূর্ণ। আজিজুর রহমান মনে করেন, কৃষিকে আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক করা গেলে শস্যের ফলন ৭ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা যাবে, উৎপাদন খরচও কমিয়ে আনা যাবে প্রায় ১৫ শতাংশ। এতে জাতীয় ফুড বাস্কেটে ১ লাখ ৭০ হাজার টন ধান বাড়তি যোগ হবে। আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা পুরো ধান উৎপাদন ব্যবস্থায় সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এক টাকা বিনিয়োগে ৫১ থেকে ৭৩ টাকা আয় হবে বলে মনে করেন আজিজুর রহমান।
ব্রি অ্যাগ্রোমেট ল্যাবের তৈরি ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেমস (আইআরএএস) প্ল্যাটফর্মটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছে বলে জানান আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আবহাওয়ার সূচকভিত্তিক শস্যবিমা পাইলট আকারে চালু করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বিমা সুবিধা পাবেন।’
প্রতিবেশী দেশসহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে এ ধরনের আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমা চালু রয়েছে।
ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য আরও যন্ত্রপাতি কিনছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে এ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে।