২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল। ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামীর নেতারা বারবার বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলে সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবেন তারা।
আয়োজন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধানকে ঠেকাতে সংগঠনটি দেশের নানাপ্রান্তে যে তাণ্ডব দেখাচ্ছিল, সে সময় তাদের নেতাদের বক্তব্য ছিল ভীষণ গরম।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগের দিন ২৫ মার্চ বায়তুল মোকাররমের সামনে সংগঠনটির সে সময়ের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির আগমনই হবে সরকারের পতনের ক্ষেত্র, যদি সরকার আমাদের দাবি না মানে।’
এই সফর চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জে তাণ্ডবের পর ২৮ মার্চ হরতাল ডাকে সংগঠনটি। আগের দিন বায়তুল মোকাররমের সামনে সমাবেশে আরেক যুগ্ম মহাসচিব ফজলুল করিম কাসেমী বলেন, ‘হরতালে বাধা দিলে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা করে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় হেফাজত সমর্থকরা। ফাইল ছবি
৩১ মার্চ হরতালে তাণ্ডবের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া ১১ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তুলাধুনা করে হেফাজত বিবৃতিতে বলে, ‘আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করার চক্রান্ত আমরা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে নস্যাৎ করে দেব, ইনশাআল্লাহ।… কোনো অপশক্তির হুমকি-ধমকিকে নায়েবে রাসুল ওলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা পরোয়া করে না।’
তবে গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে পরে সবই পরোয়া করেছে হেফাজত। সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সবাইকে। বারবার নেতারা বলছেন, রাজনীতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
হেফাজত নিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীরাই এখন হতাশ। সংগঠন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, এমন নেতার সংখ্যাও কম নয়।
এই যেমন সাবেক নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসূফী। হেফাজতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
হেফাজতের চরিত্রে পরিবর্তন হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক। আপনাদের মন্তব্য তো সব সময় যথার্থ হয়। তবে এ বিষয়ে যারা এখন সংগঠনের দায়িত্বে আছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আমি তো এখন সংগঠনের দায়িত্বে নেই।’
হেফাজতের প্রচার সম্পাদক মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘আমরা এখন রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত আছি। কারণ আমরা তো অরাজনৈতিক সংগঠন। আগে দিয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু এখন আমাদের দেয়ার সুযোগ নেই।’
গ্রেপ্তারের পর থেকেই চুপচাপ, ‘রাজনীতি থেকে দূরে’
গত বছরের এপ্রিলে প্রথমে মামুনুল হক, এরপর হেফাজতের আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে ওই বছরের মার্চ ও এপ্রিলের শুরুর দিকে সহিংসতার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সঙ্গে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের পুরোনো মামলাগুলো সচল হয়।
এরপর থেকে রাজনৈতিক কোনো ইস্যু দূরে থাক, ধর্মীয় কোনো বিষয়েও দেশজুড়ে কোনো কর্মসূচি নেই সংগঠনটির।
হেফাজত নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা সামনে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেবে না।
সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম শুরু থেকেই অরাজনৈতিক সংগঠন। রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
কোনো কর্মসূচি না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক নেতা এখনও জেলে আছেন। আমরা যদি এই মুহূর্তে কর্মসূচি দেই, তাহলে ওদের বের হওয়াটা আরও মুশকিল হয়ে যাবে। আর আমাদের আমির তো বলেছেন, সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো আমাদের কাজ না।’
সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু দেশে সামনে নির্বাচনের বিষয় আছে। এ সময় আমরা কর্মসূচি দিলে আমাদের রাজনৈতিক বলা হবে। সে জন্য আমরা কর্মসূচি দিচ্ছি না। তবে আমাদের সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতার বিষয় নেই।’
ধর্মীয় কর্মসূচিও কেন নেই জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভক্তের অভাব নেই। কিন্তু আমাদের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অনেকে জেলে রয়েছেন। এ অবস্থায় যদি আমরা কর্মসূচি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে তো সমস্যা সৃষ্টি হবে। এ জন্য আমরা কর্মসূচি দিচ্ছি না।’
- আরও পড়ুন:হঠাৎ ‘গরম’ থেকে ‘নরম’ হেফাজত
হেফাজতে ইসলামের প্রভাবশালী নেতারা মৃত্যুর কারণে সংগঠন দুর্বল হয়েছে বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘১৪ মাসের মধ্যে আমাদের চারজন মুরব্বি, দুজন আমির ও দুজন মহাসচিব মারা গেছেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য বড় ধাক্কা। এটি কাটিয়ে উঠতে আমাদের সময় লাগবে।
‘আমাদের নেতারা সবাই জেল থেকে বের হয়ে এলে, আশা করি আমরা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।’
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। ফাইল ছবি
তাণ্ডব, হুমকির পর গ্রেপ্তার অভিযান
গত বছরের ২৬ মার্চ ও এর পরবর্তী সময়ে নানা কর্মসূচি দেয় হেফাজত। এর মধ্যে ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজত সমর্থকরা।
এরপর চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় হামলা হয়। সেখানে গুলিতে প্রাণ হারায় কয়েকজন। এরপর কয়েক দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পরে নারায়ণগঞ্জে চলে তাণ্ডব।
এরপর গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারী নিয়ে মামুনুল হক অবরুদ্ধ হওয়ার পর তাকে উদ্ধার করতে গিয়েও তাণ্ডব চালান হেফাজত কর্মীরা।
হেফাজতে ইসলামের তখনকার যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গত ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফাইল ছবি
সোনারগাঁ তো বটেই, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, সুনামগঞ্জের ছাতকেও ত্রাস তৈরি করে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সেই সঙ্গে অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুক লাইভে চলতে থাকে হুমকি-ধমকি।
তবে সরকারপ্রধান পার্লামেন্টে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক স্থানে যখন হেফাজতকে সতর্ক করে দিয়ে কড়া বক্তব্য দেন, সেই সঙ্গে সহিংসতার ঘটনায় গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়, তখন হেফাজতের বক্তব্য নরম হয়ে আসে।
আরও পড়ুন: হেফাজত নেতা মামুনুল গ্রেপ্তার
বিভিন্ন মামলায় শীর্ষস্থানীয় ৩০ নেতাসহ সারা দেশে এক হাজার ২৩০ জনেরও বেশি কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
এই গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে বিএনপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেয় দুটি ধর্মভিত্তিক দল, যাদের নেতারা ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
এরপর থেকে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আর উত্তেজক কোনো বক্তব্য না দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন তাদের নেতাদের মুক্তির দাবি নিয়ে।
সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। অনুরোধ করেন তাদের সংগঠনের নেতাদের মুক্তি দিতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরের মতো বলেন, যারা নিরপরাধ তাদের সরকার আটকে রাখবে না, কিন্তু যারা অপরাধে সম্পৃক্ত, তাদের বিচার চলবে।
পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই গত বছরের সহিংসতার মামলাগুলো তদন্ত করছে। পাশাপাশি ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের মামলাগুলো সচল হয়েছে।
কমিটি বিলুপ্ত, শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু
নেতাদের মুক্তির জন্য দেনদরবারের মধ্যে ২৫ এপ্রিল রাতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন বাবুনগরী। বাদ দেয়া হয় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির করে ১৫১ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়, তাতে সিংহভাগকেই বিএনপি জোটের শরিক বিভিন্ন ইসলামী দল থেকে নেয়া হয়।
এই কমিটি বিলুপ্ত করার মাস দেড়েক পর ৭ জুন বাবুনগরী ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির কেউ সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত নন।
সে সময় হেফাজতের বলিষ্ঠ কোনো অবস্থান না নেয়াকে কেন্দ্র করে সংগঠনে হতাশা দেখা দেয়। বিভিন্ন ফেসবুক পেজে কর্মী-সমর্থকরা নানাভাবে সমালোচনা করতে থাকেন।
এর মধ্যে গত ১৯ আগস্ট মারা যান বাবুনগরীও। ২৯ নভেম্বর মারা যান মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীও।
পরে হেফাজতের আমিরের দায়িত্ব পান জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি বরাবর স্বল্পভাষী। কওমি অঙ্গনে পরিচিত হলেও সারা দেশে সেভাবে তাকে নিয়ে আলোচনা কখনও ছিল না।
কার্যক্রম কীভাবে চলছে?
শুরু থেকেই সংগঠনটির চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে পরিচালিত হতো। তবে ঢাকার মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকার খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
গত ২৯ নভেম্বর নূরুল ইসলাম জিহাদী মারা যাওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন মাওলানা সাজিদুর রহমান। তিনি সংগঠনটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার আমির ছিলেন। এরপর থেকে আবার হাটহাজারীতেই কেন্দ্র চলে যায়।
জাতীয় রাজনীতি বা কওমি অঙ্গনে সাজিদুর তেমন ‘প্রভাবশালী’ হিসেবে পরিচিত নন। আল্লামা আহমদ শফী ও বাবুনগরীর সময়ে মূল নেতৃত্বেও ছিলেন না তিনি।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ। ছবি: সংগৃহীত
বেশ কয়েক মাস পর বুধবার চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডেকেছেন সংগঠনের আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মুহিউদ্দিন রাব্বানী নিউজবাংলাকে বলেন, আসলে দীর্ঘদিন আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয় না। তবে কী বিষয়ে আলোচনা হবে সেটার আলোচ্যসূচি এখনও নির্ধারণ হয়নি।’
যেভাবে আলোচনায় হেফাজত
২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে সংগঠনটির যাত্রা।
তবে সংগঠনটি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করে ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। শাহবাগ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে ওই বছরের ৬ এপ্রিল সংগঠনটি ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে।
তাদের এই শোডাউন ব্যাপক নজর কাড়ে বিভিন্ন মহলের। তবে এর ঠিক এক মাস পর ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে শাপলা চত্বরে অবস্থানকালে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পালাতে বাধ্য হন হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। এরপর সংগঠনটি অনেকটা চুপসে যায়।
পরে সরকারের সঙ্গেও দেশের শীর্ষ এই আলেমের যোগাযোগ বাড়ে। কওমি মাদ্রাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতে কৃতজ্ঞ হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরিয়া মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধিও দেয়া হয়।
তবে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আলেমদের নিয়ন্ত্রণ চলে আসায় সংগঠনটি সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়।