শবে বরাতে খাবারের তালিকায় হালুয়া, রুটির সঙ্গে বরাবর গরুর মাংস রাখেন তৌফিক ইসলাম। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই ব্যক্তি বলেন, ‘এবারই ছিল ব্যতিক্রম। গরু বা খাসির মাংসের যে দাম, তাতে এবার কেনা সম্ভব হয়নি। সব কিছুর ব্যয় মেটাতে হাঁপিয়ে ওঠার মতো অবস্থা।’
শুধু তৌফিকই নয়, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড়সংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে মাংস। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির তালিকায় এখন জায়গা করে নিয়েছে মাংস। গরু কিংবা খাসি, সব ধরনের মাংসের দাম বাড়ছে। বলা হচ্ছে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় বাড়ছে পশুর দাম।
এক বছরের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম কেজিতে বেড়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। আর খাসির মাংসের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর সিটি করপোরেশন দাম নির্দিষ্ট করে দেয়, কিন্তু মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা তারা করে না।’
মাংসের বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে মাংস আমদানি করে বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় মাংস ও পশু আমদানির প্রতিবাদ হচ্ছে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো মন্ত্রণালয় আলোচনা করে না।’
মাংসের অতিরিক্ত দামের কারণে অনেক মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান রবিউল।
তিনি বলেন, ‘করোনার দোহাই দিয়ে গত দুই বছরে মাংস রপ্তানি বা চামড়াশিল্প নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো মিটিং হয়নি।’
কত দামে বিক্রি হচ্ছে মাংস
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, গরুর মাংস ৬৫০ টাকা ও খাসির মাংস ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
শেওড়াপাড়ার বিসমিল্লাহ মাংস বিতানের ব্যবসায়ী মাসুদ মিয়া জানান, শবে বরাতের দুই দিন আগে মাংসের দাম বেড়েছে। বাড়তি দামে তারা মাংস কিনছেন। এ জন্য তাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
আগারগাঁওয়ের ব্যবসায়ী হাবিব আলম বলেন, ‘বর্তমানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ১০-১৫ দিন আগেও বিক্রি করা হয়েছে ৬০০ টাকায়। আর খাসির মাংস ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকা। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৯০০ টাকা।’
একই এলাকার বিসমিল্লাহ গোস্ত বিতানের মূল্যতালিকা নতুন করে টানানো হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা। হাড় ছাড়া শুধু মাংস নিলে সেটা কেজিপ্রতি ৭৫০ টাকা। আর কলিজা ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। গরুর মাথার মাংস প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা, বট ২৫০ টাকা ও পায়া ৪০০ টাকা।
খাসির মাংস প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা।
লাফিয়ে বাড়ছে দাম
ট্রেডিং করপোরেশনের বাজার দরের ডাটাবেজে দেখা যায়, রোববার গরুর মাংস প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ৬২০ থেকে ৬৫০ টাকা। এক মাস আগে দর ছিল ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা। এক মাসে দর বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
২০২১ সালের একই সময়ে গরুর মাংস কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫৬০ থেকে ৬০০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
খাসির মাংস কেজিপ্রতি বিক্রি ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকা, এক সপ্তাহ আগেও যা একই ছিল। এক মাস আগে দাম ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এক বছর আগেও কেজিপ্রতি খাসির মাংস বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
ক্যাবের হিসাব
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে গড়ে ৪২০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস পাওয়া যেত। ২০১৭ সালে সেই দাম লাফিয়ে বেড়ে যায়। আগের বছরের তুলনায় এক লাফে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে ৫২০ টাকায় ওঠে ওই বছর।
২০১৮ সালে ৫২৭ টাকা কেজি ছিল গরুর মাংস। ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে হয় ৫৪০ টাকা। ২০২০ সাল শেষে গড়ে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দর ছিল ৫৮৮ টাকা। ২০২১ সাল শেষে গরুর মাংসের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৬০০ টাকা হয়।
গরুর মাংসের দাম বাড়া নিয়ে কয়েক বছর আগে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের করা একটি জরিপে বলা হয়, গোখাদ্য ও পশুর ওষুধের দাম বৃদ্ধি, চামড়ার দাম কমে যাওয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মাংসের দামে প্রভাব পড়েছে।
অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে দাম বেশি
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দামের তুলনায় বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম অনেক বেশি।
গত মার্চের তুলনায় চলতি মার্চে দেশীয় বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। গত বছরের মার্চে এক কেজি গরুর মাংস ছিল ৫৬০ টাকা। বর্তমানে সেটা ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে গরুর মাংস প্রতি কেজি ছিল ৪০০ টাকা। চলতি বছর সেটা বেড়ে প্রায় ৫০০ টাকা ছুঁয়েছে। অর্থাৎ অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গরুর মাংস কেজিপ্রতি দেড় শ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
দাম বাড়ায় কারা
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আরও বলেন, গাবতলীর গরুর হাটে একটি সিন্ডিকেট আছে, তারা সরকারের কোনো আইন-কানুন মানে না। তারা লাগামহীনভাবে মাংসের ব্যবসা করছে। পশুর হাটের খাজনা সহজ ও মাস্তানমুক্ত করতে হবে বলে জানান তিনি।
চামড়া বিক্রির ব্যবস্থা করা, সিটি করপোরেশনে একটি স্থায়ী পশুর হাট তৈরি করা এবং মানসম্মত একাধিক কসাইখানা তৈরি না করা গেলে মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ভারতীয় গরু, মহিষ ও মাংস বাংলাদেশে পাচার বন্ধ করতে হবে। চর ও বনাঞ্চলকে ২০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণের মাধ্যমে পশুপালনের আওতায় আনতে পারলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে।
মাংসের চাহিদা
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন।
দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। আর চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন।
বাড়ছে পশু উৎপাদন
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পশু উৎপাদন হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ গরু, ৪৫ শতাংশ ছাগল। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া।
গত অর্থবছর গরুর উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার। গরুর মোট উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। আগের বছর ছিল ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার।
এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে পশু উৎপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৫৯ লাখ ২৬ হাজার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ৩ লাখ ৯৯ হাজার বেড়েছে।